Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

অভিশংসনের মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। ছবি: বিবিসি।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। ছবি: বিবিসি।
[publishpress_authors_box]

সামরিক আইন জারির ব্যর্থ চেষ্টার পর অভিশংসনের মুখে পড়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েল। দেশটির সংসদ সদস্যরা তার আকস্মিক সামরিক আইন (মার্শাল ল) জারির সিদ্ধান্ত রুখে দিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিসংশন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েল সামরিক আইন জারি করেছিলেন। তবে পার্লামেন্ট সদস্যদের বিরোধিতার মুখে কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি তা প্রত্যাহারে বাধ্য হন।

তিনি দাবি করেছিলেন, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় এবং ‘উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শক্তি’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী উপাদান’ নির্মূল করতে সামরিক আইন প্রয়োজন।

তবে তার ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সংসদ সদস্যরা জাতীয় পরিষদে একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য ভোট দেন। এরপর, প্রেসিডেন্টকে অপসারণে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ঘটনা নতুন নয়। নিজেকে একটি আধুনিক ও সফল গণতন্ত্র হিসেবে দেখা দেশটি এর আগেও এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।

উন সুক ইয়েল দেশটির পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা। সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে ২০২২ সাল থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে রয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা লি জায়ে-মিউং থেকে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছিলেন।

সামরিক আইন জারির পক্ষে উন যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, বিরোধীদের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহে উস্কানি এবং পার্লামেন্টকে অপরাধীদের আখড়া বানানোর চক্রান্ত ঠেকাতে তাকে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে সামরিক আইন জারির আগে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসকদের হুমকি থেকে উদার দক্ষিণ কোরীয়দের রক্ষা, রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত নস্যাতে আমি সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিচ্ছি।

“জনগণের জীবন-জীবিকার প্রতি দায়িত্বশীলতা না দেখিয়ে বিরোধী দল সরকারকে অচল করে দিতে চাইছিল।”

দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে বিরোধীরা যখন পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তুলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মঙ্গলবার রাতে সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তার স্ত্রীর দুর্নীতির তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছিল বিরোধী দল।

প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ানদের বিক্ষোভ।

মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারির পরপরই তার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা লি জায়ে-মিউং। তিনি প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেন।

অন্যদিকে, সামরিক আইন জারির পর রাজধানী সিউলে পার্লামেন্টের জাতীয় পরিষদ ঘিরে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পার্লামেন্টের বাইরে অবস্থান নেন হাজারো বিক্ষোভকারী।

একপর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য তিন শতাধিক সেনাসদস্য পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। তখন ভবনের ওপরে হেলিকপ্টারও নামতে দেখা যায়।

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেই রাতে নিরাপত্তা বাহিনীকে এড়িয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে সক্ষম হন দেশটির ১৯০ জন আইনপ্রণেতা। তারা প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে ভোট দেন। আর এতেই আটকে যায় প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির চেষ্টা।

এখন কী হবে

এরই মধ্যে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলকে অভিসংশনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। কয়েকদিন ধরে এই প্রক্রিয়া চলবে।

অভিসংশন বিল পাস হতে হলে ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ২০০ ভোট প্রয়োজন। এই ভোট আগামি ৭২ ঘণ্টা তথা শুক্রবারের মধ্যে শেষ করতে হবে।

এখন পরবর্তী ধাপ হলো জাতীয় পরিষদের স্পিকার উ উন-সিকের অধিবেশন আহ্বান করা। এ বিষয়ে আলোচনা শুরুর জন্য তিনি দুই দিনের মধ্যেই অধিবেশন ডেকেছেন।

প্রেসিডেন্টকে অভিসংশনের জন্য বিরোধী দল এককভাবেই প্রায় প্রয়োজনীয় ভোট নিশ্চিত করতে পারবে। প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের নিজ দলের সদস্যরাও তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন, তবে তারা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অভিসংশন সফল করতে তাদের কয়েকজন সদস্যের সমর্থনও লাগবে।

যদি প্রস্তাবটি সংসদে পাস হয়, তাহলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত হবে এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন।

এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক আদালত। আদালত যদি অভিসংশন অনুমোদন করে, তাহলে প্রেসিডেন্ট অপসারিত হবেন এবং ৬০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

তবে যদি আদালত অনুমোদন না দেয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট তার পদে বহাল থাকবেন।

বুধবার সকালে দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান।

উনের উত্থান ও পতন

উন সুক ইয়েল ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে একটি নতুন মুখ ছিলেন। দেশটিতে ১৯৮০ সালে উম্মুক্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হয়। তারপর থেকে এটি ছিল দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী লড়াই।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে উন একজন প্রসিকিউটর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ২০১৬ সালে অভিসংশিত হওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার নেতৃত্ব দিয়ে তিনি জাতীয় পরিচিতি লাভ করেন।

৬৩ বছর বয়সী উন তার নির্বাচনী প্রচারে উত্তর কোরিয়া এবং বিতর্কিত লিঙ্গ সমতা ইস্যুতে কঠোর নীতির পক্ষে কথা বলেন।

তবে ক্ষমতায় আসার পর একাধিক ভুল এবং রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির কারণে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে। এর ফলে তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত গত রাতের নাটকীয় পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়।

‘লজ্জাজনক’ সিদ্ধান্তের জন্য উনকে জবাবদিহি করতে হবে

বিবিসি জানায়, সিউলের পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে বিরোধী রাজনীতিবিদরা প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের পদত্যাগ বা তার কাজের পরিণতি ভোগের দাবি জানাচ্ছেন।

প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ইয়াং বুও-নাম বিবিসিকে বলেন, “আমি খুবই হতাশ। প্রেসিডেন্ট যা করেছেন, তা লজ্জাজনক। আমাদের এ বিষয়ে সরব হতে হবে।”

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ইয়াং বুও-নাম।

তবে ইয়াং বিদেশিদের আশ্বস্ত করে বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া বিশৃঙ্খলার মধ্যে নেই।

তিনি বলেন, “আমরা একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র। কোরিয়ার মানুষ নিরাপদ থাকতে চায়। প্রেসিডেন্ট উনকে পদত্যাগ করতে হবে বা অভিসংশিত হতে হবে।”

এদিকে, বুধবার সকালে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েলের কর্মীরা দলগতভাবে পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের সব সিনিয়র সচিব, তার চিফ অব স্টাফ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং জাতীয় নীতিমালা পরিচালক পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

তবে এসব পদত্যাগ কার্যকর করতে প্রেসিডেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন। উন এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত