Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

ফিলিস্তিনকে স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের স্বীকৃতির প্রভাব কী

গত বছরের ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর থেকে থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৩৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর থেকে থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৩৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
[publishpress_authors_box]

গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের মধ্যেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে। জাতিসংঘের একাধিক ফোরামে এনিয়ে আলোচনাও চলছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত বুধবার আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশগুলো আগামী ২৮ মের মধ্যে এবিষয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করবে।

পর্যবেক্ষকরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জনের পথে একে বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। ইউরোপীয় দেশ তিনটিও বলেছে, তাদের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি অর্জনের পথকে সুগম করবে।

তবে ফিলিস্তিনের গাজায় বসবাসকারী জনগণের উপর তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সামান্য। কারণ সেখানে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ একটি ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের হাতে সেখানে ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের সর্বাত্মক হামলার পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছিল।

ইউরোপীয় দেশ তিনটির স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত পশ্চিম তীরের জনগণের জীবনে রাতারাতি কোনও পরিবর্তন আনবে না। অবশ্য হামাস ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এই স্বীকৃতির প্রশংসা করেছে। তাদের মতে, এটি ফিলিস্তিনিদের শান্তি ও নিরাপত্তার আশা জোরালো হবে।

বাম পাশ থেকে আইরিশ প্রধানমন্ত্রী সিমন হ্যারিস, স্পেনের প্রেসিডেন্ট পেদ্রো সানচেজ ও নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস ঘার।

আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অন্য যে কোনও কিছুর চেয়ে সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সম্পর্ককেই বেশি প্রকাশ করছে।

তিনটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ কূটনৈতিকভাবে প্রভাব ফেলবে। এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের বিষয়ে তাদের মিত্রদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করবে। মিত্রদের আরও খোলাখুলিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এর ফলে।

তবে এটাও ঠিক, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চাপও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চিন্তাভাবনায় বড় প্রভাব ফেলেনি।

স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হামাসের সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করা হবে বলেও অভিযোগ করেছেন নেতানিয়াহু। এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল দেশ তিনটি থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছে।

পশ্চিম তীরের সাবেক তিনটি ইহুদি বসতিতে ইসরায়েলের নাগরিকদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। বুধবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের এমন ঘোষণার পরই ইউরোপীয় দেশ তিনটিও তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

২০০৫ সালে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময় ইসরায়েল ওই তিনটি এলাকা থেকেও ইহুদি বসতিগুলো সরিয়ে নিয়েছিল। সেসময় ওই সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪০টিরও বেশি তাদের স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে। তবে ২৭ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশই এর মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাত্র ৭টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কার্যত অর্থ কী এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি ফিলিস্তিনের জন্য কতটা সহায়ক হবে সেই প্রশ্নও এখন প্রাসঙ্গিক। বাস্তবতা হলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ইস্যুতে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ শান্তি চাইলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনও পদেক্ষেপ নেয় না।

ইসায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে র‌্যালি।

আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ের ভোটারদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন করে এবং এই সিদ্ধান্তের কোনও রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে ব্যাপারটা এতটা নমনীয় নয়। দীর্ঘমেয়াদে একটি শান্তিপূর্ণ দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানকে সমর্থন করার পাশাপাশি জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষেই তাদের সমর্থনে অবিচল রয়েছে।

এর প্রধান পরিণতি হল ইসরায়েলকে সামরিক সমর্থন, যা অবশ্যম্ভাবীভাবে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত থাকার প্রশ্ন উত্থাপন করে। অর্থাৎ গাজায় বেসামরিক লোকদের হত্যায় ইউরোপীয় অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে।

ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কিনা সে বিষয়ে চাপে আছে যুক্তরাজ্য সরকার।

কিন্তু এগুলো মূলত ঘরোয়া রাজনীতির বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় সরকারগুলোর বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যকে এবং বিশেষ করে ইসরায়েলকে আমলে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রই এই অঞ্চলে সামরিকভাবে বেশি সম্পৃক্ত।

ইউরোপীয় দেশগুলোর এই অঞ্চলে তেমন কোনও প্রভাব নেই। এ ছাড়া ইউরোপীয়দের চিন্তা-ভাবনায়ও মধ্যপ্রাচ্য খুব একটা প্রাধান্য পেত না। তবে আরব বসন্তের ফলে ইউরোপে অভিবাসীদের ঢল নামার পর তাদের চিন্তায় ছেদ ঘটে।

ইউরোপের কাছে গণ অভিবাসন একদিকে নিরাপত্তা বুঁকি, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপও বটে। দেশগুলো মনে করে, শরণার্থীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীরা তাদের মহাদেশে নৃশংসতা চালায়।

তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একদমই চিন্তিত নয়। আয়রিশদের একটা বড় অংশ নিজেদের পরাধীনতার ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার প্রতি সহমর্মী। অন্যদিকে, নরওয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সাক্ষরিত বিখ্যাত অসলো চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিপুল পরিমাণ মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে এবং দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানকে সমর্থন করেছে।

গাজায় ইসরায়েলি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া ভবনের ধ্বংস্তুপের উপর বসে থাকা ফিলিস্তিনি নাগরিক।

ইউরোপীয় কমিশন বুধবারের সংবাদে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, “একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ইসরায়েলের পাশাপাশি তাদেরও শান্তিতে ও নিরাপদে বসবাসের অধিকার আছে।”

আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ের এই সিদ্ধান্ত কোনও ধরনের শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয় কিনা তা দেখার বিষয়। এটি কোনও সমন্বিত ইউরোপীয় প্রচেষ্টা নয়। নরওয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয় এবং ইইউর বাকী ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের সবাই আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, এমন সম্ভাবনাও কম। তবে তাদের সিদ্ধান্ত ইউরোপের বড় খেলোয়াড়দেরও উপর চাপ বাড়াবে। ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপ কখনও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথা বলেনি। অদূর ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেন অনেকে।

এদিকে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দপ্তর হোয়াইট হাউসও পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের দৃঢ় সমর্থক। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হওয়া উচিৎ। একতরফা স্বীকৃতির মাধ্যমে নয়।

দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র নিজের এই অবস্থান ধরে রেখেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বলেছেন, হামাস গাজায় থাকা অবস্থায় লন্ডন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে না।

তথাপি আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেনের এই স্বীকৃতির প্রতীকি গুরুত্ব আছে। বিশেষ করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি নতুন করে গতি পাবে।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ এক প্রস্তাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এবং বৃহত্তর আরব বিশ্ব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কারণ ওই প্রস্তাবে ইসরায়েলকে ৫৫ শতাংশ আর ফিলিস্তিনকে ৪৫ শতাংশ ভূমি দেওয়া হয়। অথচ ফিলিস্তিনিরা জনসংখ্যায় বেশি ছিল। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যা ইহুদীদের প্রায় দ্বিগুন।

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের একটি দৃশ্য।

কিন্তু ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবটি লুফে নিয়ে পরের বছর একতরফাভাবে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। এতে আশেপাশের আরব দেশগুলো ইসরায়েলে আক্রমণ করে। শুরু হয় প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধ। ইউরোপ-আমেরিকার অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে এই যুদ্ধে ইসরায়েল আরবদের পরাস্ত করে আরও বেশি, প্রায় ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে নেয়। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেয় জর্ডান ও গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় মিশর।

১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ওই তিনটি ভূখণ্ডও দখল করে নেয়। এরপর থেকে অসংখ্যবার আলোচনা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আর মেনে নেয়নি ইসরায়েল।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল এই দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকেও সমর্থন করেছে। তবে তারা জোর দেয় যে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিৎ। ২০০৯ সাল থেকে আর কোনও সারগর্ভ আলোচনা হয়নি।

ফিলিস্তিনকে আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেনের এই স্বীকৃতি সেই আলোচনা পুনরায় শুরু করতে ইসরায়েলের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে। এছাড়া ৬-৯ জুন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের আগে এই পদক্ষেপ ইউরোপে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুর গুরুত্বও বাড়াবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত