টানা চতুর্থবার জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকার তিনি। ২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে আসেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর।
সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ প্রদান করার জন্যই গঠন করা হয় সংসদীয় কমিটি। কিন্তু গবেষণা বলছে, সংসদীয় কমিটির সুপারিশের একটি বড় অংশই বাস্তবায়িত হয় না। এমনকি কিছু কিছু বাস্তবায়নাধীন সিদ্ধান্তের ফলোআপ না করায়, সেই বিষয়ে অগ্রগতিও জানা যায় না। অবশ্য জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, বিষয়টি ঠিক না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৫ সালে “বাংলাদেশে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকরতা: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে নবম জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটির তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নবম সংসদে ১১টি স্থায়ী কমিটি মোট সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ হাজার ৮৯১টি। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে ২০ শতাংশ। ৪১ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকের অভিযোগ, সংসদীয় কমিটিকে গুরুত্ব দেয় না মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “বিষয়টি ঠিক না। কারণ যখন কমিটি সুপারিশ করে, সেসব সুপারিশ মন্ত্রণালয়ের কিন্তু বাস্তবায়ন করার কথা। কোনও কারণে মন্ত্রণালয় কমিটির ১০টা সুপারিশের ৩টা বাস্তবায়ন করতে না পারে, কিংবা সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনও ধরনের জটিলতা থাকতে পারে।”
জানুয়ারিতে গঠন করা হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। এই সংসদের অধিবেশনের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যেই গঠন হয়ে গেছে সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটিগুলোর গুরুত্ব প্রসঙ্গে স্পিকার বলেন, “এত অল্পসময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের একটি উদ্দেশ্য কমিটিকে আরও কার্যকর করা। এসব কমিটির প্রতিমাসে একটি করে বৈঠক করার কথা।”
করোনার সময় অনেকগুলো কমিটির কার্যক্রম ব্যাহত হয় উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, “হয়তো তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে অনেক কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তবে করোনার আগে কমিটির বৈঠক ধারাবাহিকভাবে হয়েছিল। আশা করি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের কমিটির বৈঠক নিয়মিত হবে। আমরা কমিটিকে সেইভাবে আহ্বান জানাব, ওনারা যেন সচেতন থাকেন। প্রতি মাসে যেন সভাটা হয়।”
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন ৬২ জন, যাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দলের প্রতি আনুগত্যের কথাও জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও ক্ষমতাসীন দলের জোটেই ছিল একসময়। এ বাস্তবতায় চলতি সংসদ সরকারি দলের জবাবদিহিতা কতটা নিশ্চিত করতে পারবে জানতে চাওয়া হয় স্পিকার শিরীনের কাছে।
জবাবে স্বতন্ত্ররা সবাই যে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করে এসেছে সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন স্পিকার। তিনি বলেন, “তারা হয়তো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থাকতে পারে। মাঠে যখন ইলেকশন করেছে তখন তারা নৌকার বিরুদ্ধে করেছে। কাজেই সেই প্রেক্ষাপটে আপনি তাকে নৌকার পক্ষের বিষয় বলতে পারেন না।”
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং বা ৭০ অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা নেই উল্লেখ করে শিরীন শারমিন বলেন, তাদের যথেষ্ট ফ্রিডম আছে কথা বলার। তারা চাইলে বলতেই পারে।
সংসদে বিরোধী দলের সদস্য খুব কম (১১) হলেও তাদের সুযোগ না দেওয়া হলে, তাদের ফ্লোর না দেওয়া বা বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের যে অংশগ্রহণ- সেটা না করা হলে তাদের ভূমিকা সংকুচিত করা হবে বলে মন্তব্য করেন স্পিকার।
তার মতে, “(বিরোধী দলে) যারা রয়েছেন তারা যদি সংসদীয় প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউরের মধ্যে পারফর্ম না করে, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরে উপস্থিত না থাকে তাহলে আপনি সেটাকে কীভাবে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসবেন।”
সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হচ্ছে সংসদে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও উত্তর- একথা উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, “মন্ত্রীদের সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে, মন্ত্রীরা উত্তর দিতে বাধ্য। এমন কোনও উত্তর তারা দিতে পারবেন না যেটা তারা করবেন না। গ্রহণযোগ্য উত্তর তাদের দিতে হবে। সেখানে একটা জবাবদিহির মধ্যে তারা পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন প্রতি বুধবার। কাজেই তিনিও জবাবদিহিতার মধ্যে পড়ছেন।”
বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপেক্ষিত হয়েছে বলে কথা উঠলেও স্পিকার শিরীন শারমিন মনে করেন একথা ঠিক নয়।
তিনি বলেন, সাবেক মন্ত্রীর সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে কমিটি থেকে কোনও ধরনের ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণের সুযোগ থাকলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতো।
উদাহরণ হিসেবে স্পিকার বলেন, “একজন মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যর মালিকানায় হাসপাতাল রয়েছে এবং তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব যে হবেই সে রকম না ।”