সংসদ যখন বিলুপ্ত, নির্বাচিত সরকার যখন নেই, তখন স্পিকারের পদত্যাগের ফলে কী হতে পারে?
সোমবার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পদত্যাগের খবর আসার পর এই প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মনে।
স্বাভাবিক সময়ে স্পিকারের পদত্যাগের ঘটনা এক রকম হবে; কিন্তু আন্দোলনে সরকার পতনের পর স্পিকারের পদত্যাগ অনেককে কৌতূহলী করে তুলেছে।
কেউ জানতে চাইছেন, সংসদ যখন কার্যকর নেই, তখন স্পিকারের থাকা কিংবা না থাকাটার কি কোনও পার্থক্য রয়েছে? আবার কেউ বুঝতে চাইছেন, এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কী হবে?
সংরক্ষিত নারী আসন থেকে ২০০৯ সালে প্রথম সংসদে যাওয়া শিরীন শারমিন চৌধুরী টানা চতুর্থ বার আইন সভার প্রধান বা স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রথম নারী হিসাবে বাংলাদেশের সংসদের স্পিকারের চেয়ারে বসে ইতিহাসের অংশ তিনি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় সংসদে স্পিকারের পদে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল মালেক উকিল, তার জেলা নোয়াখালীরই সন্তান শিরীন শারমিন। তবে নোয়াখালী থেকে নয়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রংপুরের পীরগঞ্জ আসন থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
এই বছরের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনকারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সেদিনই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর জানান। পরদিন দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি।
তিন দিন দেশ সরকারহীন থাকার পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপ্রধান।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ আমলে বাদ দেওয়ার পর যখন নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, তখনই সাংবিধানিক পদ থেকে শিরীন শারমিনের পদত্যাগের খবর এল।
সংবিধান অনুযায়ী, যে কোনও সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকেই স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করতে হয়।
সেই অনুযায়ী গত ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে শিরীন শারমিন স্পিকার এবং শামসুল হক টুকু ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সরকার পতনের পর অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপির মতো স্পিকারেরও কোনও খবর নেই ৫ আগস্ট থেকে। কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, সেদিন শিরীন শারমিন সংসদ ভবনেই ছিলেন। জনতা সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ার পর তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ডেপুটি স্পিকার টুকুকেও সংসদ ভবন এলাকায় তার বাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর জানিয়েছিল, ৫ আগস্ট উত্তাল অবস্থায় ২৪ জন রাজনীতিকসহ ৬২৬ জনকে নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তবে পরে ৬১৫ জন নিজেরাই সেনানিবাস ছেড়ে যান। ৪ জনকে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৭ জন এখনও সেনানিবাসে রয়েছেন।
ডেপুটি স্পিকার টুকুকে গত ১৪ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। কিন্তু শিরীন শারমিনের অবস্থান এখনও অজানা। তিনি সেনানিবাসে ওই সাতজনের একজন কি না, তাও জানানো হয়নি।
ফলে তিনি কোথা থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন, তা জানা যায়নি। তবে তিনি স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন এবং তা কার্যকর হয়েছে বলে সোমবার রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে আসা প্রজ্ঞাপন স্পষ্ট করেছে।
পদত্যাগে সংকট কী
সংবিধানের ৭৪ (২) অনুচ্ছেদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য কোন কোন ভাবে হয়, তা বলা আছে। সেখানে লেখা আছে, স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার রাষ্ট্রপতির নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদ ত্যাগ করলে তাদের পদ শূন্য হবে।
অর্থাৎ শিরীন শারমিনের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি পাওয়ার পর স্পিকার পদটি শূন্য হলো।
এখন নতুন স্পিকার নিয়োগের বিধান আছে সংবিধানের ৭৪ (১) অনুচ্ছেদে।
সেখানে বলা আছে, স্পিকার/ডেপুটি স্পিকার পদের যে কোনোটি শূন্য হলে সাত দিনের মধ্যে কিংবা ওই সময়ে সংসদ বৈঠকরত না থাকলে পরবর্তী প্রথম বৈঠকে তাহা পূর্ণ করার জন্য সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করতে হবে।
তবে এখন যেহেতু সংসদই নেই, ফলে সাতদিনের বাধ্যবাধকতা এখানে প্রযোজ্য হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সংসদ বসলে তখনই নতুন স্পিকার নির্বাচনের সুযোগ আসবে।
নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনও সংসদের প্রথম বৈঠক শুরু হয় আগের সংসদের স্পিকারের সভাপতিত্বে।
গণআন্দোলনে এইচ এম এরশাদের সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদের প্রথম বৈঠকে আগের ‘রাবার স্ট্যাম্প’ সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীকে নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। তবে শেষমেষ নিয়ম মেনে তার সভাপতিত্বেই সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছিল। নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করে দিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন।
একইভাবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট করেও আন্দোলনের কারণে বিএনপি সরকার টিকতে না পারার পরও সপ্তম সংসদের প্রথম অধিবেশন ষষ্ঠ সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর সভাপতিত্বে শুরু হয়েছিল।
প্রশ্ন আসছে, শিরীন শারমিন বিদায় নেওয়ায় আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে, তা কার সভাপতিত্বে হবে?
এবিষয়ে সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের ৬ নম্বর ধারায় বলা আছে, অনুচ্ছেদের (২) দফার (পদ শূন্য হওয়া সংক্রান্ত) বিধানাবলী সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
যার অর্থ দাঁড়ায়, পদত্যাগপত্র দিলেই হচ্ছে না, তাতে পরবর্তী স্পিকারের কাছে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া অবধি শিরীন শারমিনের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না।
এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিককে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো লিখেছে, পরবর্তী সংসদ না আসা পর্যন্ত স্পিকার তার পদে বহাল থাকেন।
আবার সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদেরই ৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, স্পিকারের পদ শূন্য হলে তার সব দায়িত্ব ডেপুটি স্পিকার পালন করবেন। ডেপুটি স্পিকারের পদও শূন্য হলে সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি-অনুযায়ী কোনও সংসদ সদস্য সে দায়িত্ব পালন করবেন।
এখন স্পিকার পদত্যাগ করলে তার পদ শূন্য হচ্ছে। কিন্তু এই ধারা অনুযায়ী, তার সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারছেন ডেপুটি স্পিকার টুকু। তিনি বন্দি হলেও পদত্যাগ করেছেন বলে জানা যায়নি। ফলে তার স্পিকারের দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে।
ফলে সংসদ যেহেতু নেই, নতুন স্পিকার নির্বাচনের সুযোগও নেই। কিন্তু ডেপুটি স্পিকার থাকলে তিনি স্পিকারের দায়িত্ব চালিয়ে নিতে পারছেন।
কী হবে যদি রাষ্ট্রপতির আসন শূন্য হয়
সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন।
সেখানে বলা আছে, “রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদের মাধ্যমে। এখন সংসদই যেহেতু নেই, সেক্ষেত্রে নতুন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগ নেই।
সেক্ষেত্রে মো. সাহাবুদ্দিন দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে স্পিকারের সেই দায়িত্বে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি পদত্যাগপত্র দেওয়ায় এখন তেমন পরিস্থিতি হলে তিনিই কি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসবেন? না কি ডেপুটি স্পিকার হিসাবে টুকু স্পিকারের দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসবেন, তা সংবিধানে স্পষ্ট নেই।
আবার সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে তাকে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হয় স্পিকারের কাছে।
এখন স্পিকার যদি কেউ না থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে তা কার কাছে করবেন, সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
শিরীন শারমিনের পদত্যাগের প্রসঙ্গ ধরে শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, “এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, ডেপুটি স্পিকার বন্দি, তাতে সংবিধান মেনে চলা হলে দেখা যায়, এতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।”
আবার সংবিধানে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই সময়ে নির্বাচন করতে না পারলে তা সাংবিধানিক সংকট তৈরি করবে বলে এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তবে ড.মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের বিষয়ে যে এখনই ভাবছে না, তা স্পষ্ট। তারা সংবিধান সংস্কারের পক্ষে মনোযোগ দিচ্ছে।
দুদিন আগেই বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ড. ইউনূসের সংলাপের পর তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ করতে চায় এই সরকার।
“প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কীভাবে হবে, বিচারের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান কি সংস্কার করব, না কি পুনরায় লেখা হবে– সেটা নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান পরিবর্তন নাকি পুনঃলিখন চায়– সে বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা অনুরোধ করেছেন।”
সংবিধান সংস্কার কিংবা সংশোধন কিংবা পুনঃলিখন হলে তা গৃহীত কীভাবে হবে, সে বিষয়ে একটি গণভোট আয়োজন করতে হবে, এমনটাই একটি কলামে লিখেছেন অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম।