বাংলাদেশে নারীরা এগিয়েছে অনেক; সরকারের শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে নীতি-নির্ধারণের জায়গায়ও নিয়েছে স্থান। এই ধারাবাহিকতা তৃণমূল পর্যায়েও দেখছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
হালের চিত্র দেখিয়ে তিনি বলছেন, “দেশের নারী নেতৃত্বের চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আমরা নারীদের ভোটেই বিজয়ী হয়েছি। এক একটা এলাকায় মা-বোনেরা বক্তব্য শোনার জন্য দীর্ঘসময় ধরে বসে থাকে, তারা রাজনৈতিক বক্তব্য শোনে, যাতে কাকে ভোট দেবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয় মা-বোনেরা।”
একে নারী শক্তির জাগরণ বলছেন টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের আইন সভার স্পিকারের দায়িত্ব নেওয়া শিরীন শারমিন চৌধুরী। শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে সকাল সন্ধ্যাকে একথা বলেন তিনি।
সংসদে স্পিকার পদে শিরীন শারমিন চৌধুরীই প্রথম নারী। ২০১৩ সালে ৩০ এপ্রিল তিনি যখন এই পদে আসীন হন, তখন তার বয়স ৪৬ বছর। বয়সের হিসাবে তিনি দেশের সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার। দুই দিক মিলিয়েই অনন্য অবস্থানে তিনি।
শিরীন শারমিন বলেন, “অনেকেই আমাকে বলেছেন, পরপর চার বার স্পিকার হওয়ার ঘটনা বিরল। এমনটা সাধারণত দেখা যায় না। আমার জানামতে, সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ পর্যন্ত একজন স্পিকার হয়েছিলেন।”
টানা চতুর্থবার কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, “প্রথমত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চারবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। যেহেতু দল চারবার ক্ষমতায় এসেছে, তাই আমি চারবার নির্বাচিত হয়েছি।
“আরেকটা দিল হলো সরকার টানা ক্ষমতায় এলে একজনকেই স্পিকার নির্বাচিত করা হবে, এটা নির্ধারিত বিষয় নয়। এই পদে অন্য কেউ নির্বাচিত হতে পারে। সেদিক থেকে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এত বড় সম্মানের জায়গায় আমি আসতে পেরেছি।”
এই পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে একজন নারীকে চাইছিলেন, সেটাও বলেন তিনি।
“ভারত ও পাকিস্তানে নারী স্পিকার দেখা গেছে কিন্তু বাংলাদেশে এ পদে দীর্ঘসময় ধরে কোনও নারী ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব ইচ্ছা ছিল, এ পদে একজন নারীকে আনবেন।”
২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে বসেন শিরীন শারমিন। এরপর মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। মো. আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর স্পিকার পদে আসেন শিরীন শারমিন।
নিজের সেই পদে আসা পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী হিসাবে দেখেন শিরীন শারমিন।
তিনি বলেন, “আমি যখন প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন বেশ আলোচনা হয়। একদিকে নারী, তার ওপর সর্বকনিষ্ঠ; আলোচনা তো হবেই। আমরা সাধারণত প্রথাগতভাবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী এসব গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে অভিজ্ঞ, প্রথিতযশা নেতাদের দেখতেই অভ্যস্ত।
“তবে আমরা যেসময়ে রাজনীতিতে এসেছি, তখন ছিল পরিবর্তনের সময়। আমাদের অনেক অভিজ্ঞ নেতাদের আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের সংসদ উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী নারী নেতৃত্বের সামনের সারিতে ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তার। আরেকজন হলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এমন আরও জ্যেষ্ঠ নেতাকে বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে আমরা হারাই। সেদিক থেকে হয়তো আমাদের সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটু তরুণ-নবীন এমন কাউকে সামনে আনতে চেয়েছিলেন।”
অপেক্ষাকৃত কম বয়সে গুরুদায়িত্ব পাওয়াটা চ্যালেঞ্জের ছিল শিরীন শারমিনের কাছে।
“তরুণ হিসেবে আমার আসাটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সময়ের প্রবাহে সবাই তা গ্রহণ করেছে এবং স্থায়িত্বের দিকে গেছে, যেটা ভালো। যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম, সব চ্যালেঞ্জ নিয়েই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। আমার নিজের জবাবদিহিতার জায়গা থেকে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষের প্রত্যাশা, সমালোচনার ক্ষেত্রে আমার জবাব কী হবে, তা নিয়ে সবসময় ভাবতে হয়েছে আমাকে।”
দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিজেরও সচেতন থাকতে হয়েছে শিরীন শারমিনকে।
তিনি বলেন, “নারী হিসেবে যে দায়িত্ব পেয়েছি, সেটা যদি ঠিকভাবে পালন করতে না পারি, তাহলে অন্য সব নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একজন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি তা পালন করতে পারেননি-এমনটা বলতে শোনা যাবে। তাই স্পিকারের দায়িত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হয় আমাকে।”
শেখ হাসিনা যে আস্থা রেখেছেন, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হচ্ছে শিরীন শারমিনকে।
“কারণ আমাকে নিয়ে উনার যে আকাঙ্ক্ষা, যা উনি বাস্তবায়ন করেছেন, সেটা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তা মাথায় রেখে কাজ করতে হয় আমাকে। এত বড় দায়িত্বে আসতে পেরেছি, দেশকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।”
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীর মেয়ে শিরীন ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন আইন বিষয়ে। ১৯৯০ সালে এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসাবে ১৫ বছর অনুশীলন করেন তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনটি ছেড়ে দিলে সেখানে উপনির্বাচনে জয়ী হন শিরীন শারমিন। একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও ওই আসন থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
দেশে এখন স্পিকারের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতার পদে নারীরা আছেন। সরাসরি ভোটে ২০ জন নারী নির্বাচিত হয়ে এবারের সংসদে রয়েছেন।
সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে পুরো নারী সমাজের নেতৃত্বের চিত্র কি ফুটে ওঠে?
এ প্রশ্নে শিরীন শারমিন বলেন, “তৃণমূল পর্যন্ত নারীকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপের বাস্তবায়নের ফল এই জাগরণ। নারী নেতৃত্ব কেবল প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা মন্ত্রী পদে সীমাবদ্ধ নেই। নারী নেতৃত্ব প্রতিটি গ্রামে গ্রামে।
“আমরা যারা জনপ্রতিনিধি, নেতাকর্মীদের প্রতি আমাদের একটাই নির্দেশ ছিল-ভ্যানগাড়িতে মা-বোনদের তুলবে এবং ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসবে, আর কিছু লাগবে না। জয় আমাদের নিশ্চিত। এ হচ্ছে নারী নেতৃত্বের ক্ষমতায়নের ফসল।”