পঞ্চাশোর্ধ্ব আব্দুর রহমান সাইয়্যাদু সুলাইমান নিজের কথা শোনাতে চেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েককে।
বৃহস্পতিবার কলম্বোর মারাডানার আবেসিংহরামা মন্দিরের ভোট কেন্দ্র থেকে দিসানায়েকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুলাইমান তাকে নিজের কথা শোনাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের বাধায় পারেননি।
সুলাইমান পরে বলেছিলেন, “আমি চাই (দিসানায়েক) আমার জনগণের দুর্দশার কথা শুনুক। সাবেক সরকার যখন কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন একটি মৃত মুসলিম শিশুর দেহ আগুনে পুড়িয়েছিল, আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি আমার ধর্মের পক্ষে কথা বলেছি। মুসলিম জনগণের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা হয়নি।”
সুলাইমানের আশা যে দিসানায়েকে তাদের ন্যায়বিচার দেবেন, যা তার পূর্বসূরিরা সারা শ্রীলঙ্কাজুড়ে খুঁজে পায়নি। এই আশায়ই সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্য-বাম নেতা দিসনায়েককে মুসলমানরা ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দিয়েছিলেন। এখন, সেই আশার পরীক্ষা হবে, যেমন আগে কখনও হয়নি।
দিসানায়েকের ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বা জাতীয় গণশক্তি বৃহস্পতিবারের সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে ১৫৯টি আসন পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। প্রধান বিরোধী দল সামগী জনা বালাওয়েগায়া (এসজেবি) তাদের নেতা সাজিথ প্রেমাদাসার অধীনে মাত্র ৪০টি আসন জিতেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের নিউ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট পেয়েছে পাঁচটি আসন এবং রাজাপাকসে পরিবারের শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি), যা ২০২২ সালের গণঅভ্যুত্থানের আগে গত দুই দশক ধরে দেশটির রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, মাত্র তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে।
কলম্বো থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়া এনপিপির সামানমালি গুনাসিংহে বলেছেন, “আমরা খুশি যে এখন আমরা জনগণের জন্য কাজ করতে পারছি। তারা দেখিয়েছে, পুরনো রাজনীতি থেকে তাদের পরিবর্তন দরকার।”
পরিবর্তনের জন্য ভোট
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুণা কুলাতুঙ্গা বলেন, ১৯৭৭ সালে সংসদীয় ব্যবস্থাকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে পরিবর্তন করার পর এই প্রথমবার শ্রীলঙ্কায় কোনও দল স্পষ্টভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
এমনকি এবারই প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্টের কাছে কোনও মিত্র বা জোটের অংশীদারদের উপর নির্ভর না করে সংসদে আইন পাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
“অতএব, এই ফলাফলের গুরুত্ব হলো যে, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা জাতিগত, ধর্মীয় এবং মতাদর্শগত দিক থেকে বিভক্ত ছিল, এবার একটি একক দলের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কারণ বিগত জোট সরকারগুলোতে যে ক্ষমতার দরকষাকষির কারণে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ত, এবার আর তা নেই।”
দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিসানায়েকের দল এখন একাই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। এনপিপি নির্বাচনের আগে একটি নতুন সংবিধান নিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।
এনপিপির কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। দিসানায়েকের মার্কসবাদী দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার নেতৃত্বে এনপিপিতে একাধিক সংগঠন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলো, যারা ২০২২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় একত্রিত হয়েছিল। এরপর গণঅভ্যুত্থানে গোতাবায়া ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছিলেন।
কলম্বোর দেহিওয়ালার দিনমজুর বসন্ত রাজ (৩৮) বলেন, তিনি তার এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এনপিপি প্রার্থীদের নাম জানেন না। তবে জোটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কে এটির প্রতিনিধিত্ব করছে তা বিবেচ্য নয়।
“আমরা বছরের পর বছর ধরে একই লোকদের জন্য ভোট দিয়ে আসছি এবং কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এইবার, আমরা দেখব এরা (এনপিপি) কী করে,” বলেন রাজ।
উত্থান
২০২২ সালের বিক্ষোভের পর থেকে রাজনৈতিক নেতা হিসাবে দিসানায়েকের উত্থান ঘটতে থাকে। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের মন জয় করে নেন।
২০২২ সালের বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাজাপাকসে পরিবারের অধীনে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পতন নিয়ে ক্ষোভ। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা সেসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
রাজাপাকসেদের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছেন।
কিন্তু আইএমএফের সঙ্গে চুক্তির অংশ হিসাবে ব্যাপকহারে সরকারি ব্যয় কমিয়েছিলেন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কাটছাঁট করেছিলেন এবং কর বাড়িয়েছিলেন।
এমএফ সারিনা (৬৩) যিনি তার ৮৩ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে কলম্বোর ডেমাটাগোডায় একটি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন, তিনিও আশা করেন, নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন এবং গরিব মানুষদের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করবেন।
সারিনা বলেন, “আমার মা খুব অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধ এবং আমি তার দেখাশোনা করছি। প্রতিদিনের খরচ মেটাতেই আমাদের হিমশিম খেতে হয়। খাবারের দাম বেশি, ওষুধ একেবারে নাগালের বাইরে। আমরা আশা করি, এই পরিস্থিতির শিগগিরই পরিবর্তন হবে।”
শুক্রবার সমস্ত ফলাফল ঘোষণার পরে এনপিপির সেক্রেটারি নিহাল আবেসিংহে দলটির ঘাড়ে যে জনগণের বিশাল আশার বোঝা রয়েছে, তা স্বীকার করেছেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চিত করব যে, অতীতে যারা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, সেইভাবে আমরা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করব না।”
তামিল সমর্থন
শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের তামিলরা এবার এনপিপিকে বেশি ভোট দিয়েছে। আগে তারা শুধু তামিল কোনও দলকেই বেশি ভোট দিত। উত্তরাঞ্চলে এনপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে।
তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চল তামিল বিদ্রোহী এবং শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর মধ্যে তিন দশকের গৃহযুদ্ধের সময় সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল ছিল। যুদ্ধটি শেষ হয়েছিল ২০০৯ সালে। শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনী তামিল সশস্ত্র নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেয়।
জাফনা ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক আহিলান কাদিরগামার বলেন, পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগের সপ্তাহগুলোতে উত্তরের তামিল সম্প্রদায় থেকে এনপিপির প্রতি সমর্থনের একটি স্পষ্ট তরঙ্গ ছিল।
তিনি বলেন, অনেক তামিল ভোটার তাদের সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তাদের জন্য আরও ভাল বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থতার জন্য ক্ষুব্ধ।
আহিলান কাদিরগামার বলেন, এখন এনপিপির জন্য কঠোর পরিশ্রমের সময় শুরু হয়েছে। উত্তর ও পূর্বের জনগণের উদ্বেগ দূর করার জন্য, নতুন শ্রীলঙ্কা সরকারকে অবশ্যই গৃহযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরের দখলকৃত জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই দেশের তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ দূর করতে হবে, যারা বারবার জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
“এটা কোনও সহজ কাজ নয়,” যোগ করেন কাদিরগামার।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা