Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

অর্থনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে

জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ি।
ছাত্র-জনতার যে আন্দোলনে সরকারের পতন হয়েছে, তার মধ্যে সংঘাতে পোড়ে অনেক গাড়ি। ছবি : হারুন অর রশীদ রুবেল
Picture of আবদুর রহিম হারমাছি

আবদুর রহিম হারমাছি

বেশিদিন আগের কথা নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জাদুতে মোহিত ছিল গোটা বিশ্ব। আর সেই কৃতিত্ব নিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তার বিদায় তার সরকারের দুর্বল নীতিই প্রকাশ্যে এনেছে। শুধু তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির ওপর নির্ভর করে দাঁড়ানো তার অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর কর্মসংস্থানের চাপ সামলাতে পারেনি।

সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি আর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব। যার পরিণতিতে তাকে বিদায় নিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে।

এখন বাংলাদেশকে তার ভবিষ্যৎ পথ ঠিক করতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে এভাবেই মূল্যায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস। সোমবার পত্রিকাটিতে প্রকাশিত যে প্রতিবেদনে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার শিরোনাম ছিল- ‘সবগুলো ডিম অর্থনীতির একটি ঝুড়িতে রেখেছিল বাংলাদেশ, এখন তার মূল্য চুকাতে হচ্ছে’।

দুর্নীতি আর অনিয়মের মধ্যেই এগিয়ে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেও টলে পড়ে ২০২ সালে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর।

তারপর এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ল। আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক ইউনূসের একাডেমিসিয়ান পরিচয় ছাপিয়ে তাকে বিশ্ববাসী দেখে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। তাকে চেনে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দ্রারিদ্র্য বিমোচনের পথের দিশারি হিসাবে। সেই কাজই তাকে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল।  

গ্রামীণ ব্যাংক চালিয়ে আসা ইউনূসের সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন মূল কাজ হবে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ঠিক করা আর অর্থনীতৈনিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।

অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার কত দিন থাকবে, তা অনুমান করা এখনও কঠিন। তবে তার ওপর যে অনেক চাপ থাকবে, তা বলছেন কানাডার বালসিলি স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো সাদ হাম্মাদি।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ন্যায়বিচার করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি অর্থনীতিতে কার্যকর গতিশীলতা আনার প্রত্যাশা এখন তার ওপর।

অস্বাভাবিকভাবে সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে কোনও কিছুই এখন স্বাভাবিক নয়। সুশৃঙ্খল নয় অর্থনীতিও।

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কোনও ব্যাংকেই স্বাভাবিক কাজ চলছে না। কেউ ব্যাংক থেকে দিনে ২ লাখ টাকার বেশি তুলতে পারছে না। ডলারের দামের উর্ধ্বমূখীই আছে।

গত এক দশকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ব্যবসায়ীদের অনেকে এখন লাপাত্তা। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সুস্থির নয়। আন্দোলনের মধ্যে রেমিটেন্সেও নামে ভাটা। মূল্যস্ফীতি চড়ছেই, অন্যদিকে কমছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ।

রেমিটেন্স

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই সূচক বেশ ধাক্কা খেয়েছে। জুলাই মাসে ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এই অঙ্ক ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৩ শতাংশ কম।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকারের দমন-পীড়ন শুরু হলে রেমিটেন্স না পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান ছিল আন্দোলনকারী একদলের। আবার আন্দোলনের মধ্যে সরকার ইন্টারনেট দিয়েছিল বন্ধ করে। দুটোর প্রভাবই পড়ে রেমিটেন্সে।

চলতি অগাস্ট মাসের ১০ দিনে রেমিটেন্স এসেছে ৪৮ কোটি ২৭ লাখ ডলার। মাসের বাকি ২১ দিনে এই হারে আসলে মাস শেষে অঙ্কটি দাঁড়াবে ১৪৯ কোটি ২৭ লাখ ডলার।

গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসাবে জুন মাসের রেমিটেন্স ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিল প্রবাসীরা।

শীতলক্ষ্যা নদীতে লাইটার জাহাজ; এই জাহাজগুলো পণ্য সমুদ্রবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করে। ছবি : জীবন আমীর

রপ্তানির হিসাবে গড়বড়

তথ্য সংশোধনের ফলে প্রবৃদ্ধিতে থাকা রপ্তানি আয় নেতিবাচক হয়ে গেছে। আর এতে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হিসাব দিয়েছে ওলটপালট করে। পতনের আগে রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে।

এরই মধ্যে গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের (জুলাই-মে) রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ওই ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ কম।

অথচ তার আগে ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো হিসাবে রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আয়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে ওই ১১ মাসে ২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রপ্তানি আয় ১৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।

অর্থবছর শেষ হওয়ার দেড় মাস হতে চললেও গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনের তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

সংশোধিত হিসাবে বিশাল অঙ্কের এই রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারও কমে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এর আগেই নতুন হিসাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওলটপালট হয়ে যাওয়ার তথ্য দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। আর আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার।

অথচ আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার।

আবার সচল হচ্ছে ঢাকার জীবনযাত্রা, রবিবার ট্রাফিক পুলিশও কাজে নামে। ছবি : জীবন আমীর

বেহাল বিনিয়োগ

সরকারি কিংবা বেসরকারি সব বিনিয়োগই বেহাল। অর্থ সংকটের কারণে এডিপি কাটছাঁট করে যাচ্ছিল সরকার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দসহ সব মিলিয়ে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ২ লাখ টাকা। পরে তা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি কমিয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি ৬৪ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) গত অর্থবছরের ১১ মাসের (জুলাই-মে) এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছে সরকার। বাস্তবায়নের হার ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যা চার অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

অন্যদিকে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কম।

রিজার্ভের পতন ঠেকছে না

গত ৩১ জুলাই রিজার্ভের সবশেষ তথ্য প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার।

এর আগে গত ৩০ জুন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।

গত ২৭ জুন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। তবে পরদিন আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়। এছাড়া বাজেট সহায়তার ঋণ হিসেবে বিশ্ব ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারও যোগ হয় রিজার্ভে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

সেই হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন কাঁটায় কাঁটায় আছে।

বর্ষার শেষে এসে বুড়িগঙ্গায় বেড়েছে পানি, তাতে মাছ ধরাও চলছে। ছবি : জীবন আমীর

ডলারে অস্থিরতা লেগেই আছে

ডলারের বাজার অস্থির বছর খানেক ধরেই। আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও নগদ ডলারসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকায়।

গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খোলাবাজারে ডলারের দর বেড়ে ১২৬ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর ৮ মে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর আগ পর্যন্ত ডলারের দর ১২১ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে উঠানামা করে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ১২০ টাকার নিচে নেমে আসে।

আইএমএফের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে। এর মাধ্যমে এক লাফে প্রতি ডলারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঘোষণা করা হয় ১১৭ টাকা। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের দর নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকা।

গত রবিবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ১১৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও একই দর নিয়েছে। অন্য সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সব ক্ষেত্রে ডলারের দর নিয়েছে ১১৮ টাকা।

আন্দোলন শুরুর আগে ব্যাংকগুলোতে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকার মধ্যে ডলার কেনাবেচা হচ্ছিল।

মাওয়ায় শুকানো হচ্ছে পাট, স্বাধীনতার পর এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। ছবি : জীবন আমীর

মূল্যস্ফীতি চড়ছে

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাব দেখাচ্ছে, তা আরও চড়েছে।

জুলাই মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

আগের জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে।

দেশে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।

রাজস্ব আদায়েও স্বস্তি নেই

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মোট ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।

গত অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরে তা ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে।

সরকারের খরচের জোগানের অন্যতম বড় উৎস শুল্ক-কর। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চললে শুল্ক-কর আদায় নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না।

কিন্তু জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংঘাতের পর ক্ষমতার পালাবদল হলেও অস্থিরতা কাটেনি। এমন অবস্থায় আমদানি পণ্য খুব খালাস হয়নি। আবার স্থানীয় পর্যায়ে দোকানপাট তেমন একটা খোলেনি। খুললেও বেচাকেনা তেমন নেই।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চূড়ান্ত হিসাব আসেনি। তবে শুল্ক-কর আদায় আগের বছরের জুলাই মাসের তুলনায় অর্ধেকে নামতে পারে।

গত বছর জুলাই মাসে ২০ হাজার কোটি ৬০০ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করেছিল এনবিআর।

সামনের দিনগুলো কেমন যাবে-তা নিয়েও আছে নানা অনিশ্চয়তা।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

কী ভাবছেন অর্থ উপদেষ্টা

গতি হারানো অর্থনীতির সূচকগুলো নিয়ে উদ্বেগের কথা ইতোমধ্যেই জানিয়েছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে সবার আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল পুলিশ। সরকার পতনের পরপরই থানাসহ পুলিশের অসংখ্য স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পুলিশহীন দেশে আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন নাগরিকরা। কয়েকদিন পর শনিবার থেকে পুলিশ আবারও সক্রিয় হতে শুরু করেছে। 

অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে এখন সবার আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করার ওপর জোর দিচ্ছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন যত দ্রুত সম্ভব আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে আমাদের অর্থনীতিকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে।”

সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার পর মুল্যস্ফীতি কমাতে জোরাল পদক্ষেপ চাইছেন সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, “অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইউনূস নিজের কাছেই রেখেছেন।

অর্থ উপদেষ্টার বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সেলিম রায়হান; “কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুবই উদ্বিগ্ন।”

অর্থ উপদেষ্টাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, “কারণ, এটি বাজার স্থিতিশীল করতে বড় ভূমিকা পালন করে।”

দেশ যে কঠিন পরিস্থিতিতে, অর্থনীতিতে যে জটিল অবস্থায়, তা পুরোপুরিই বুঝতে পারছেন উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অর্থনীতিতে নানান ধরনের সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকের সমস্যা রয়েছে, মূল্যস্ফীতির সমস্যা রয়েছে। আরও অনেক ধরনের জটিলতা আছে। সবক্ষেত্রেই কাজ করতে হবে।

“তবে এই মুহূর্তে মূল কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা। আইনশৃঙ্খলা মানে শুধু রাস্তাঘাটের আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং ব্যাংক পুরোপুরি চালু করা, বন্দরগুলো অনেকাংশে অচল– সেগুলো চালু করা।”

শ্লথ অর্থনীতি এক বারেই গতিশীল হয়ে যাবে, তা মনে করছেন না সাবেক এই গভর্নর। তবে ধাক্কাটি দিতে চান তিনি।

সালেহউদ্দিন বলেন, “অর্থনীতি একেবারে লাইনচ্যুত হয়ে যায়নি। মন্থর হয়েছে ও গতি হারিয়েছে। আমরা গতি বৃদ্ধি করব।”

সংকট থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের অফুরান কর্মস্পৃহা আশাবাদী করছে নতুন সরকারের উপদেষ্টাকে। 

“সুবিধা হলো, বাংলাদেশের মানুষের অফুরন্ত কর্মস্পৃহা আছে,” বলেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত