তীব্র বিক্রির চাপে ফের দরপতনের ধারায় পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। তবে ভয়ের কিছু নেই বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, লেনদেন ভালো হচ্ছে, বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যসীমা তুলে নেওয়ার পর গত সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ১৮০ পয়েন্ট বা ২.৮৫ শতাংশ কমে নামে ৬১৫৬ পয়েন্ট, যা ২০২২ সালের আগস্টের পর সর্বনিম্ন। যদিও গত সপ্তাহে প্রতিদিনের গড় লেনদেন বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।
এরপর এ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক ডিএসইএক্স হারিয়েছে ৭৭ পয়েন্ট, তবে এ বাজারে লেনদেন আগের দিনের চেয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা বেড়েছে।
গত সপ্তাহে দুই দিন ভালোর ইঙ্গিত দিলেও আবার দরপতন শুরু হয়েছে। শেষ তিন কার্যদিবস দেশের দুই পুঁজিবাজারেই মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। এই তিন দিনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ২০০ পয়েন্টের মতো। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চিত্রও একই।
৩৫টি কোম্পানিকে হাতে রেখে বাকিগুলোর শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পর গত সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার বড় দরপতনের পর দুই দিন (সোম ও মঙ্গলবার) বাজারে সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সবাই ভেবেছিলেন বাজার বোধ হয় এবার ঘুরে দাঁড়াবে।
কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। টানা দরপতনে ফের হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইএক্স কমেছে ৭৭ দশমিক ২৪ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। সূচক নেমে এসেছে ৬ হাজার ৭৯ পয়েন্টে। গত বুধবার ডিএসইএক্স পড়েছিল ৫০ পয়েন্ট। পরের দিন বৃহস্পতিবার কমেছিল আরও বেশি, ৭০ দশমিক ২৪ পয়েন্ট।
রবিবার সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৬৫ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৫১ শতাংশ কমে ১৭ হাজার ২৮৬ দশমিক ২৩ পয়েন্টে নেমেছে। বুধবার এই সূচক পড়েছিল ৩৪৭ দশমিক ২৭ পয়েন্ট। বৃহস্পতিবার কমেছিল ২৫৯ দশমিক ১৮ পয়েন্ট।
তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই। বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
বাজার বিশ্লেষক ডিএসইর বর্তমান পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন “সর্বনিম্ন মূল্যস্তরের কারণে অনেকে দীর্ঘদিন শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। ফলে মূল্যস্তরে উঠে যাওয়ায় যাদের নগদ অর্থের বেশি প্রয়োজন ছিল, তাদের অনেকেই শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। সে কারণে বাজার সমন্বয় হচ্ছে। এই সপ্তাহটা এমনই যাবে। আগামী সপ্তাহ থেকেই বাজার ঘুর দাঁড়াবে।”
তবে টানা দরপতনে ফের হতাশ ও ক্ষুব্ধ ছোট বিনিয়োগকারীরা। শামীম আহমেদ নামের একজন ছোট বিনিয়োগকারী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সবাই বললে ফ্লোর পাইস উঠে গেলে বাজার ভালো হবে। অনেক দিন পর হাউসে যাওয়া শুরু করেছিলাম। শেয়ার কেনা-বেচা করছিলাম। আশা করছিলাম ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠব। কিন্তু টানা বড় পতনে হতাশ হয়েছি। জানি না আগামী দিনগুলো বাজার কেমন যাবে।”
দেড় বছর পর গত ১৮ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে বেশিরভাগ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে বহাল রাখা হয় অনেকটা বড় মূলধনি ৩৫টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস।
বেশিরভাগ শেয়ার থেকে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দর তুলে নেওয়ার পর প্রথম কার্যদিবস ২১ জানুয়ারি (গত সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার) দুই পুঁজিবাজারেই মূল্যসূচকের বড় পতন হয়, কমে যায় লেনদেনও। তবে পরের দুই দিন (সোম ও মঙ্গলবার) বাজারে চাঙাভাব দেখা যায়। লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকায় উঠে।
২৩ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) থেকে আরও ২৩টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পরও সূচকের উত্থানে আশা সঞ্চার হয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তবে বুধবার ফের দরপতনে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক লোকসান বেড়েছে।
বাজারে এখন ১২টি ছাড়া সব কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়েছে বিএসইসি।
তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ৩৯২টি, এর মধ্যে ৩৮০টির শেয়ারদরের সর্বনিম্ন সীমা তুলে নেওয়া হলো।
তবে বাজারের এই দরপতনে ‘ভয়ের কিছু নেই’ বলে আশ্বস্ত করেছেন শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
শাকিল রিজভী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা ঠিক যে, পর পর তিন দিন বাজারে বড় পতন হয়েছে। তার আগে কিন্তু দুই দিন বেড়েছিল। লেনদেনের গতি কিন্তু বেশ ভালো ছিল। লেনদেন বাড়াকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। আমি মনে করি বাজার ঠিক আছে। ফ্লোর পাইস উঠে যাওয়ার পর বিক্রির চাপ বেড়েছে। সে কারণে মূল্যসূচক কমেছে।
“তবে আমি মনে করি, বাজার এখন ঠিক হয়ে যাবে যাবে; ভালোর দিকে যাবে। বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে। দেখেশুনে বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আমি বলব- মূল্যসূচকের দিকে না তাকিয়ে শেয়ারের গতিপ্রকৃতি দেখে বিনিয়োগ করুন।’’
“আতঙ্কিত হয়ে কোনও শেয়ার বিক্রি করে দেবেন না। হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে” যোগ করেন তিনি।
শাকিল রিজভী বলেন, “মূলত বিক্রির চাপেই মূল্যসূচকের পতন হচ্ছে। বিক্রি বাড়ার অন্য একটি কারণও আছে। দুই কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন জমা নেওয়া চলছে। কোম্পানি দুটি হচ্ছে— বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড ও এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড।
“দুটি কোম্পানি নিয়েই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অনেকে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে এই দুই কোম্পানির আইপিও আবেদন করছেন।”
রবিবারের বাজার পরিস্থিতি
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইতে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৭ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ৭৯ পয়েন্টে।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে শরীয়াহ সূচক ‘ডিএসইএস’ ১৫ দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৩৩৭ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ২৩ দশমিক ৫৬ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
রবিবার ডিএসইতে ৮৮০ কোটি ৬১ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৮৭০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
লেনদেন হয়েছে ৩৯৪টি কোম্পানির। এর মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৫৭ টির, কমেছে ৩১১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৬টির দর।
অন্যদিকে সিএসই সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৬৫ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট কমে ১৭ হাজার ২৮৬ দশমিক ২৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
লেনদেন হওয়া ২৭০টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৪৮টির, কমেছে ২০৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৪টির দর।
লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল অঙ্ক ছিল ১৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।