সোশাল মিডিয়ায় অসংখ্য হ্যাশট্যাগের জেরে গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনায় ভারতের পুঁজিবাজার। কারণ কেবল বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নয়, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ঘিরেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট-বিনিয়োগকারী হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এক্সে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করেছিল, ‘বড় কিছু’ আসছে।
কয়েক ঘণ্টা পরেই বাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়ার (সেবি) প্রধান মাধবী পুরি বুচকে অভিযুক্ত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এতে বিতর্কিত আদানি গোষ্ঠীর ব্যবহৃত অফশোর তহবিলের সঙ্গে মাধবী সংযোগ থাকার অভিযোগ করা হয়। তবে মাধবী ও আদানি গ্রুপ উভয়েই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
হিন্ডেনবার্গ গত বছর আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে নির্লজ্জভাবে পুঁজিবাজারে কারসাজি ও অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতির অভিযোগও করেছিল।
তবে ভারতের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির গ্রুপটি তা অস্বীকার করেছে। আদানি গ্রুপ পণ্য ব্যবসা, বিমানবন্দর, ইউটিলিটি, বন্দর ও পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করে।
অবশ্য ওই অভিযোগের পর আদানি গ্রুপ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লোকসানের মুখে পড়ে। সেবি এখনও সেই অভিযোগগুলো তদন্ত করছে।
কিন্তু এবার হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ, আদানিদের ব্যবহৃত তহবিলের সঙ্গে মাধবী বুচের যোগসূত্র সেবির তদন্তকে প্রভাবিত করেছে।
মাধবী বুচ বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগেই ওসব বিনিয়োগ করা হয়েছিল।
এছাড়াও, আদানি গ্রুপের স্টক বা সেবির তদন্তের সঙ্গে তহবিলে তার বিনিয়োগের প্রভাব পড়ার কোনও সরাসরি প্রমাণও নেই।
নতুন অভিযোগের পর সোমবার ট্রেডিং শেষে আদানি গ্রুপের বাজার মূল্য ২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে কী আছে
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এবং অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের আগের নিবন্ধগুলোরও উল্লেখ করা হয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে, বারমুডা ও মরিশাসের অস্বচ্ছ অফশোর তহবিলের সঙ্গে আদানির ব্যবসায়িক সহযোগীদের সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
হিন্ডেনবার্গ অভিযোগ করেছে, মাধবী বুচ ও তার স্বামী ধবল বুচ ২০১৫ সালে এই সাব-ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগ করেছিলেন।
ফার্মটি বলেছে, মাধবী বুচ ২০১৭ সালে সেবির পূর্ণকালীন সদস্য হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে, তার স্বামী তহবিল প্রশাসকের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি, “অ্যাকাউন্টগুলো পরিচালনার জন্য একমাত্র অনুমোদিত ব্যক্তি” হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাধবী বুচ তার ব্যক্তিগত ইমেইল আইডি ব্যবহার করে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ফার্মে তার স্বামীর তহবিলে বিনিয়োগের সম্পূর্ণ অর্থ উদ্ধারের জন্যও চিঠি লিখেছিলেন।
সংস্থাটির অভিযোগ, “আমাদের সন্দেহ, মাধবী বুচের কারণেই আদানি গ্রুপের সন্দেহভাজন অফশোর শেয়ারহোল্ডারদের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ ব্যবস্থা নিতে সেবির এই অনীহা। গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানির ব্যবহৃত ঠিক একই তহবিল সেবির চেয়ারপারসন মাধবী বুচও ব্যবহার করেছেন।”
হিন্ডেনবার্গ ২০১৯ সালে মাধবী বুচের স্বামীর যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক ব্ল্যাকস্টোনের উপদেষ্টা হওয়ার সময়ও বাধা দিয়েছিল। ব্ল্যাকস্টোন ভারতীয় রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ ট্রাস্টেও বিনিয়োগ করেছিল।
অভিযোগ, সদস্য ও চেয়ারপারসন হিসেবে মাধবী বুচের মেয়াদে সেবিতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে ব্ল্যাকস্টোনের মতো সংস্থাগুলো সরাসরি উপকৃত হয়েছে।
মাধবী বুচের প্রতিক্রিয়া কী
মাধবী বুচ ও তার স্বামী এক বিবৃতিতে বলেছেন, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে উল্লেখ করা বিনিয়োগগুলো ২০১৫ সালে করা হয়েছিল। সে সময় তারা সিঙ্গাপুরের নাগরিক ছিলেন। আর মাধবী সেবিতে পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে যোগ দেন তার দুই বছর পর।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মাধবী বুচের তৎকালীন চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার অনিল আহুজার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে ওই বিনিয়োগ করা হয়েছিল। অনিল আহুজার কয়েক দশকের শক্তিশালী বিনিয়োগ ক্যারিয়ার রয়েছে।
তাদের দাবি, অনিল আহুজা তাদের নিশ্চিত করেছিলেন, তহবিলটি কোনও বন্ড, ইক্যুইটি বা আদানি গ্রুপের কোনও কোম্পানির ডেরিভেটিভে বিনিয়োগ করেনি।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বাজার নিয়ন্ত্রকের কাছে তথ্য প্রকাশ এবং প্রত্যাহার করার নিয়মগুলোর যে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে, তারা তা যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টকে ‘সেবির বিশ্বাসযোগ্যতার’ উপর আক্রমণ এবং ‘তার চেয়ারপারসনের চরিত্রে কালিমা’ লেপনের প্রচেষ্টা বলেও অভিহিত করা হয়।
ব্ল্যাকস্টোনের সঙ্গে মাধবী বুচের স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, বিনিয়োগ সংস্থাটি মাধবী বুচের ‘সেবির সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ তালিকার’ অংশ ছিল।
সেবি কী বলছে
বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গের অভিযোগগুলোর ‘যথাযথ তদন্ত’ করেছে।
সংস্থাটি জানায়, তার চেয়ারপারসন ‘সিকিউরিটিজ হোল্ডিং ও তাদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে’ তথ্য প্রকাশের যে বাধ্যবাধকতা আছে তা পালন করেছেন। আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে এমন ক্ষেত্র থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করেছেন।
আদানি গ্রুপের বক্তব্য কী
রবিবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আদানি গ্রুপ অভিযোগগুলোকে পুরোনো অভিযোগেরই পুনরাবৃত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। তাদের দাবি, অভিযোগগুলো বিভ্রান্তিকর, যেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হয়েছে এবং ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আমাদের বিদেশি হোল্ডিং কাঠামো সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, সমস্ত প্রাসঙ্গিক বিবরণ নিয়মিতভাবে অসংখ্য পাবলিক নথিতে প্রকাশ করা হয়।”
আদানি গ্রুপের দাবি, অনিল আহুজা ২০০৭-২০০৮ সালে আদানি পাওয়ারের থ্রিআই বিনিয়োগ তহবিলের মনোনিত পরিচালক ছিলেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আদানি এন্টারপ্রাইজেরও পরিচালক ছিলেন তিনি।
বিবৃতিতে বলা হয়, “আমাদের সুনাম নষ্ট করার এই পরিকল্পিত প্রচেষ্টায় উল্লিখিত ব্যক্তি বা বিষয়গুলোর সঙ্গে আদানি গ্রুপের কোনও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই।”
১৮ মাস আগে হিন্ডেনবার্গের আগের প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারে কারসাজি এবং হিসাব জালিয়াতির যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তার ফলে আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলো তাদের বাজার মূল্য থেকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার হারায়। পরে অবশ্য তারা লোকসান কাটিয়ে উঠে।
জানুয়ারিতে ভারতের শীর্ষ আদালত অভিযোগের অতিরিক্ত তদন্তের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে গ্রুপটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আদালত সেবিকে তার তদন্ত শেষ করার জন্য তিন মাস সময় দিয়েছিল। কিন্তু সেবি সেই সময়সীমার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারেনি। সেবির সর্বশেষ বিবৃতি অনুসারে, এটি ২৩টি তদন্ত সম্পন্ন করেছে এবং শেষটিও ‘সম্পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি’।
জুনে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চকে কারণ দর্শানোর একটি নোটিশ জারি করে সেবি। নোটিশে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বাজি রাখা এক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে হিন্ডেনবার্গের যোগসাজশের অভিযোগ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। তবে হিন্ডেনবার্গ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।
রাজনৈতিক বিতর্ক
ভারতের পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, “এসব অভিযোগ থেকে সেবির সততা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সংস্থাটির দায়িত্ব ক্ষুদ্র খুচরা বিনিয়োগকারীদের সম্পদ রক্ষা করা।”
বিরোধী দল কংগ্রেস অভিযোগগুলোর একটি সংসদীয় তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে এবং সরকারকে স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে সেবি থেকে আদানির সমস্ত প্রভাব দূর করতে বলেছে।
আদানিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদের অভিযোগ, আদানি তার রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে উপকৃত হয়েছেন।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের অভিযোগ করেছে।
সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, সেবি ও মাধবী বুচ উভয়েই বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করায় সরকারের কাছে এই বিষয়ে আর বলার কিছু নেই।
এরপর কী
মাধবী বুচের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় হিন্ডেনবার্গ তাদের অভিযোগকে আরো জোরালো করেছে। তারা বলেছে, এটি অনেক নতুন গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
সেবি, মাধবী বুচ ও আদানি গ্রুপ হিন্ডেনবার্গের সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে এখনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বিরোধী রাজনীতিকরাও বারবার বিষয়টি উত্থাপন করতে থাকবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি