জন্মের পাঁচ বছর পরই টাইফয়েডে ভুগে শরীরের নিচের অংশ অকার্যকর হয়ে পড়ে মো. সেলিমের। তবে দিনমজুর বাবা-মা তাকে নিয়ে কোনোদিন হতাশ হননি। তাদের অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসায় প্রতিবন্ধিতা জয়ের লড়াই শুরু করেন সেলিম। ভর্তি হন স্কুলেও।
ধীরে ধীরে যখন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, সে সময়ই তার জীবনে নেমে আসে ঝড়। এক সড়ক দুর্ঘটনায় হারান বাবা-মা দুজনকে। তখন সেলিমের বয়স মাত্র ১৩ বছর।
এরপর সেলিমের ঠাঁই হয় খালার বাসায়। সেখানে থেকেই চালিয়ে গেছেন লেখাপড়া। আর্থিক অনটনে সপ্তম শ্রেণির পর আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি। কিন্তু কম্পিউটার চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ সংক্রান্ত ছোট-খাটো কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। মোট কথা নিজেকে সাবলম্বী করতে যা যা করা দরকার, করেছেন।
তার ফলাফলও পেলেন সোমবার। একটি পোশাক কারখানা তাকে বেছে নিয়েছে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের অ্যাডমিন হিসেবে।
নারায়াণগঞ্জের পঞ্চবটির সেলিমের মতো স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ফতুল্লার ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন আব্দুল্লাহ আল মামুনের (২৪)। বিকালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) আয়োজিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি মেলা থেকে পেয়েছেন একটি পোশাক কারখানার ওভারলক মেশিন অপারেটরের চাকরি।
মেলা প্রাঙ্গণেই কথা হলো সেলিম, মামুনসহ অন্যদের সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে এলো বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা, জানা গেল প্রত্যেকের আলাদা যুদ্ধের কথা।
ফতুল্লার কুতুবপুরের চা বিক্রেতা মোক্তার হোসেনের ছেলে মামুন বললেন, “জন্ম থেকেই চোখে সমস্যা আমার। দুই হাত দূরের জিনিসও দেখতে স্পষ্ট পাই না। অভাবের সংসারে বাবা কখনোই চিকিৎসা করাতে পারেননি। চোখে দৃষ্টি না থাকলেও কিছু করার স্বপ্ন ছিল সবসময়। এক পর্যায়ে একজনের পরামর্শে গার্মেন্টেসের ওভারলক মেশিন চালানোর ওপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিই।”
সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই চাকরি মিলেছে তার। এভাবে স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে ভাবেননি, সকাল সন্ধ্যাকে বললেন মামুন।
দ্য ইউনাইটেড নেশনস পার্টনারশিপ অন দ্য রাইটস অব পারসনস উইথ ডিজাব্যালিটিস মাল্টি-পার্টনার ট্রাস্ট ফান্ডের (ইউএনপিআরপিডি এমপিটিএফ) অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বে এই মেলার আয়োজন করা হয়।
মেলায় অংশ নিয়েছিলেন আড়াই শতাধিক প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থী। যার মধ্যে থেকে ৪৫ জনকে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এদের কেউ হাঁটতে পারেন না, কেউ শুনতে পান না, কেউ কথা বলতে পারেন না আবার কেউ দেখতে পান না।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে এসেছিলেন রকিবুল ইসলাম। শাহজাদপুর নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ থেকে বিবিএ শেষ করার পর পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এমবিএ করেছেন তিনি।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ই-শিখনে কাস্টমার সাপোর্ট এক্সিকিউটিভ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রকিবুল। আগামী ১ মার্চ যোগ দেবেন নতুন চাকরিতে। সেই আনন্দ ছিল তার চোখে-মুখে।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার চলার পথে বাধা তৈরি করেছে অনেক, কিন্তু থামিয়ে দিতে পারেনি। পরিবারের সদস্যদের উৎসাহ আর নিজের মনোবলের কারণে সব বাধা পেরিয়ে আসতে পেরেছি। তাই যাদের প্রতিবন্ধকতা আছে তাদের বলব, আপনারা হতাশ না হয়ে লেগে থাকুন, তাহলে সাফল্য আসবেই।”
মেলার আয়োজন সংস্থা বিবিডিএন জানিয়েছে, একদিনের মেলা থেকে টিমগ্রুপ বাংলাদেশে নিয়োগ পেয়েছেন ২৪ জন। এছাড়াও শেলটেকে দুইজন, সুপার শপ স্বপ্নে পাঁচজন, এক্সেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে একজন, সিআরপিতে দুইজন, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ই-শিখনে একজন ও উর্মি গ্রুপে ছয়জনসহ ৪৫ জন চাকরি পেয়েছেন।
ঢাকার কদমতলীর দক্ষিণ দনিয়ার জাকি ইসলাম জন্ম থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তাকে নিয়োগ দিয়েছে স্বপ্ন। মেলায় সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিয়োগপত্র তুলে দেন জাকির হাতে।
প্রতিবন্ধী ছেলের এই সাফল্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা আয়েশা পারভীন। তিনি বলেন, “জন্ম থেকেই কানে অনেক কম শোনে জাকি, বলতে গেলে শুনতেই পায় না। এরপরও আমার ছেলে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছে। আজ চাকরিও পেল। আর আমার চেয়ে খুশি আর কেউ নেই।”
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে নিয়োগকর্তাদের অঙ্গীকার দৃঢ় করতে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন বিবিডিএনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুর্তজা রাফি খান।
দিনব্যাপী চাকরি মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বিবিডিএন যাদের চাকরির ব্যবস্থা করেছে তাদের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখে। তাদের চাকরি জীবন কেমন যাচ্ছে, কেউ ছেড়ে দিল কিনা, ছেড়ে দিলে তার কারণ কী ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হয়।”
বিবিডিএন’র উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন কাসেম খান জানান, মেলায় পোশাক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাত, রং শিল্প, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দক্ষতার ১ হাজার ২০০ জন প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থী মেলার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। এর মধ্যে থেকে ২৫০ জনের বেশি মেলায় অংশ নেন। সেখান থেকেই যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের হাতে পত্র তুলে দেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দীপু মনি বলেন, “এই চাকরি মেলার প্রধান বিষয় সহমর্মিতা আর সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন। সমাজে মানুষের বড় একটি অংশ প্রতিবন্ধিতার শিকার। তাদের নিয়ে যে সচেতনতা ও সহমর্মিতার জায়গা এখন তৈরি হয়েছে। আগে এই অবস্থা ছিল না। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও বিবিডিএন’র মতো প্রতিষ্ঠানের কারণে প্রতিবন্ধিদের নিয়ে মানুষের ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এখন কেউ আর প্রতিবন্ধিদের বোঝা হিসেবে দেখে না।”
সাধারণ মানুষের মানসিকতা আরও বদলাতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনও কাজই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, বিবিডিএনের মতো অন্যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।