ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়াম মোহাম্মদের বাবা আতিক মোহাম্মদ শামীম মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে একের পর এক ফোন করছিলেন তার চেনাজানা সংবাদকর্মীদের। তার প্রশ্ন একটাই- বুধবার তার সন্তানের স্কুল বন্ধ, নাকি খোলা?
কিন্তুই কারও কাছ থেকে এর সদুত্তর পাচ্ছিলেন না। বুঝতেই পারছিলেন না, পরদিন সন্তানকে নিয়ে কী করবেন?
আতিকের এই ধন্দের কারণ শিক্ষা বিভাগের এক নির্দেশনা; যেখানে বলা হয়েছে, কোনো এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যাবে।
দেশে শীত যখন জাঁকিয়ে বসেছে, তখন শিক্ষা বিভাগের এই নির্দেশনা থেকে স্কুল বন্ধের কথা ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। ফলে অভিভাবকদের অনেকেই পড়েন বিভ্রান্তিতে।
আতিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিক্ষা অধিদপ্তর নিজেরা তালগোল পাকানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাগল বানাচ্ছে। তারা কী বোঝাতে চাইল আর কী বুঝে বিজ্ঞপ্তিতে কী লিখল, সেটা জানার জন্য তো তাহলে অধিদপ্তরে কল করতে হবে সবাইকে।”
আবার শিক্ষা বিভাগের এমন নির্দেশনার পর বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তথ্য। তারা বলছেন, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামবে, এমন ঘটনা বিরল।
তা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের কোনো এলাকায় শীতজনিত কারণে স্কুল বন্ধ রাখার সুযোগ ঘটছে না।
নির্দেশনায় তালগোল
পৌষের শেষ লগ্নে শৈত্য প্রবাহ শীত নামিয়েছে গোটা দেশে। মঙ্গলবার সবচেয়ে কম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় শ্রীমঙ্গলে, ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এটা সর্বোচ্চ নয়, সর্বনিম্ন।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার দুপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে এক বিশেষ নির্দেশনা আসে। তাতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে এবং এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর নিচে নেমে যাবে (সংশ্লিষ্ট আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের তথ্য অনুযায়ী) আঞ্চলিক উপপরিচালকরা ওইসব জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেবেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা এবং সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রির নিচে নেমেছে। অর্থাৎ সেখানে চাইলে মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করা যেতে পারে।
নির্দেশনাটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে মাউশির আঞ্চলিক উপপরিচালকদের কাছে পাঠানোও হয়।
এই নির্দেশনা শব্দটি ‘সর্বোচ্চ’ নাকি ‘সর্বনিম্ন’ হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েন অভিভাবকরা। সোশাল মিডিয়ায় এনিয়ে ক্ষোভও ঝাড়েন অনেকে। তারা বলেন, তাপমাত্রার হিসাবে বোধহয় তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে মাউশি।
এদিকে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পর বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধন আনে মাউশি। নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেসব জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাবে, আঞ্চলিক উপপরিচালকরা ওইসব জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেবেন।
এতে অভিভাবকরা আরও গোলমেলে অবস্থায় পড়ে যান। সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, প্রাথমিকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী?
শীতে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি কষ্ট হয় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের। তাই ছোট্ট শিশুদের নিয়ে উদ্বেগে থাকেন ক্ষুদেদের অভিভাবকরা।
কিন্তু মাধ্যমিকের নির্দেশনার পরও কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বিকালে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “স্কুলে এখনও শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
এর কয়েক ঘণ্টা পর মাধ্যমিকের মতো নির্দেশনা আসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও। তাতে বলা হয়, যেসব জেলার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাবে সেখানে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে বিভাগীয় উপপরিচালকরা সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতে পারবেন।
ঢাকার গ্রীন রোডে এক স্কুলের নার্সারির যমজ দুই শিশুর মা জেসমিন পাপড়ি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথমে ঘোষণা দিল মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, কিন্তু কষ্ট তো বেশি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের। প্রথম ভাবনা তো তাদের কাছ থেকে আসার কথা ছিল।”
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কী বলছে
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এখন যে জাঁকালো শীত চলছে, জানুয়ারি মাসের পুরোটাই কাটতে পারে এমন আবহাওয়াতে। বুধবার দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা বা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হতে পারে।
আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কোথাও কোথাও মঙ্গলবার রাতের কুয়াশা বুধবার দুপুর পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। চলতি শীতে কয়েকটি মৃদু থেকে মৃদু ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হবে। মাঝারি থেকে সেটা তীব্র না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু দিনের তাপমাত্রা যেহেতু কমে গেছে, কুয়াশার কারণে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই শীত অনুভূত হচ্ছে বেশি। যদিও বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার তাপমাত্রা বেশি।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল নওগাঁর বদলগাছীতে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি, বগুড়াতে ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি, তাড়াশে ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি, ঈশ্বরদীতে ১২ ডিগ্রি, রংপুরে ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি, তেঁতুলিয়ায় ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি, ডিমলায় ১১ ডিগ্রি, দিনাজপুরে ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি।
কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে তাড়াশে, ১৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এই মৌসুমে কখনও ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামেইনি।
তাই শিক্ষা বিভাগের নির্দেশনার কারণও বোধগম্য নয় আবহাওয়া অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের কাছে।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার মনে হয়, শিক্ষা অধিদপ্তর মিসটেক করেছে বা মিসটেক হতে পারে তাদের। সর্বোচ্চ নাকি সর্বনিম্ন হবে, এটা জানতে আপনারা ওদের (শিক্ষা অধিদপ্তর) সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।”
“আমি যতদূর জানি, আমাদের দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় না, অন্তত আমার জানা নেই,” বলেন তিনি।