Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে স্বাচিপ-ড্যাব কেন থাকবে, প্রশ্ন চিকিৎসকদের

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে গত ২ আগস্ট সমাবেশ করেছিল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। ছবি : সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে গত ২ আগস্ট সমাবেশ করেছিল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। ছবি : সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ যাচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষের হাতে। হাসপাতালগুলোও এর বাইরে নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের হাসপাতালগুলোতে চলছে জবরদখল। শীর্ষ পদগুলো দখলের পাশাপাশি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পদোন্নতিও হচ্ছে রাতারাতি।

এমন অরাজক পরিস্থিতির অবসান চান সাধারণ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, দেশের বড় বড় সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত যখন হচ্ছে, তখন চিকিৎসক ও শিক্ষকদের রাজনীতিও বন্ধ করা দরকার।

জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক– এই পেশাজীবীদের সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিৎ নয়।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ঢাকার বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই ভাংচুর চালায় বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সমর্থকরা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়মবহির্ভূতভাবে দুই শতাধিক শিক্ষককে দেওয়া হয় পদোন্নতি।

এতদিন এই হাসপাতালগুলো একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ)। তখন বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকরা ছিল কোণঠাসা। পদোন্নতিতেও অবহেলিত ছিলেন তারা। তাই আওয়ামী লীগের পতনে বিএনপি ক্ষমতায় না এলেও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠছে ড্যাব।    

বিএসএমএমইউয়ের একাধিক চিকিৎসক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকরা বঞ্চিত ছিল ঠিকই, কিন্তু এমন দ্রুতগতিতে পদোন্নতিও অবিশ্বাস্য। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই পদোন্নতি ভুল নজির তৈরি করল।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের ঠিক তিন দিন পর বিএসএমএমইউতে মোট ২২৩ জন শিক্ষক-চিকিৎসকের পদোন্নতি হয়। আওয়ামী লীগ আমলে তারা ছিলেন বঞ্চিত।

বর্তমানে ড্যাবের দখল মানসিকতা দেখে চিকিৎসকদের আশঙ্কা, পুরনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে চিকিৎসা খাত।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলই চিকিৎসকদের দলাদলি বন্ধ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন সাধারণ চিকিৎসকরা।

তাদের মতে, চিকিৎসকদের পেশাভিত্তিক যে সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) রয়েছে, তা শক্তিশালী হলেই রক্ষা হবে চিকিৎসক-রোগীর অধিকার।

অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনে সরকার পতন হওয়ার পর গত ১০ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক কাউন্সিলের সভায়।

এরপর ধাপে ধাপে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় আরও মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালের এক চিকিৎসক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা যখন দেখি ‘মেরিটোক্রেসি ওয়ার্ক’ করে না তখন তেলের পুকুরে নামা ছাড়া উপায় থাকে না, কারণ পিছিয়ে থাকার গ্লানি সহ্য করাও কঠিন। এ এক উভয় সংকট। আমরা তো মেধাভিত্তিক মূল্যায়নই চাই। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার সে সুযোগ দেয় না।”

মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-চিকিৎসকদের রাজনীতি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন কি না- জানতে চাওয়া হয়েছিল জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কাছে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, চিকিৎসকদের পেশাভিত্তিক সংগঠন বিএমএ কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলির কারণে এখন অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ স্বাচিপ ও ড্যাবের কারণে ক্ষমতায়িত চিকিৎসকরা।

“তাই এখনই স্বাচিপ ও ড্যাব বিলুপ্ত করে বিএমএকে শক্তিশালী করা উচিৎ। রাজনীতির কারণে বিএমএ কোনও রোল প্লে করতে পারে না। ছাত্ররা যদি রাজনীতি না করতে পারে, তাহলে মেডিকেলের সবার রাজনীতি বন্ধ করা উচিৎ।”

স্বাচিপ ও ড্যাব বন্ধ করা উচিৎ কি না– এই প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একজন চিকিৎসক বলেন, “অবশ্যই।”

কেন বন্ধ করা উচিৎ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এগুলো কোনও কল্যাণকর কিছু না। সেটা না চিকিৎসকদের জন্য, না সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবার জন্য।”

তার মতে, স্বাচিপ বা ড্যাব রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি বিগত ৩০ বছরে।

অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ২০০৪-২০১৫ পর্যন্ত স্বাচিপের মহাসচিব এবং ২০১৫-২০২২ পর্যন্ত সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন।

তিনিও চিকিৎসকদের রাজনৈতিক সংগঠন বন্ধ করার পক্ষে সায় দেন।

কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থক এই চিকিৎসক বলেন, “কেবল চিকিৎসকই না, কোনও পেশাজীবীর জন্যই এটা ভালো না। কারণ দলীয় রাজনীতির কারণে পেশাগত উন্নয়ন এবং পেশার উৎকর্ষবাধাগ্রস্ত হয়।”

তার মতে, বিএমএ সেদিন থেকে দুর্বল হতে শুরু করেছে যেদিন থেকে ড্যাব গঠিত হয়েছে, সেটা ১৯৯১ সালে। এরপর ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় স্বাচিপ।

সেটা কেন হলো জানতে চাইলে ইকবাল আর্সলান বলেন, “ড্যাব গঠিত হওয়ার পর রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীরা বঞ্চিত হতে শুরু করে, তখনই স্বাচিপ গঠিত হয়। ড্যাবের বাইরে যারা ছিল, তাদের নিয়েই এটা গঠিত হয়, তবে গঠনতন্ত্রে ছিল– স্বাধীনতার পক্ষের সবাই এর সদস্য হবেন।”

স্বাচিপ ও ড্যাবের কারণে বিএমএ দুর্বল হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ক্রমান্বয়ে এটি দুর্বল হয়েছে, গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। অথচ বিএমএ শক্তিশালী থাকলে চিকিৎসকদের অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী থাকত, চিকিৎসক-রোগী সুরক্ষা পেত। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক বেশি আস্থা থাকত।”

সংগঠন হিসেবে বিএমএ অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এর সাবেক সভাপতি এবং জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুবও। তার ভাষায়, “বিএমএ এখন আর সবল নয়, ভীষণ দুর্বল।”

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পেশার সঙ্গে যখন রাজনীতি মিলে যায় তখন এটা হবেই। তাই পেশার সঙ্গে রাজনীতি মেলানো যাবে না। অপরদিকে রাজনীতি যারা করবে তারা পেশায় আসবে না– এটাই হওয়া উচিত মূলমন্ত্র।

“বিএমএ-তে তারাই আসবেন যারা দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকবেন, রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব পেশাজীবীদের কাছে এটা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু সেটা হবে না বলেই বিএমএ দুর্বল।”

এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার ড্যাবের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত