নতুন সরকারের দায়িত্ব নিতে দেশে ফেরার সময় ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে স্বাগত জানাতে অনেকেই ভিড় করেছিলেন বিমান বন্দরের সামনে। সেই ভিড়ের মধ্য থেকে এক নারী শিক্ষার্থীর বক্তব্য শুনছিলাম টেলিভিশনে। নতুন সরকারের কাছে তাঁর প্রত্যাশা কী, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছিলেন, ‘‘আসলে শুধু সরকার বদল হলে চলবে না, আমাদের সিস্টেমটা বদলাতে হবে। এই সিস্টেমের ফাঁক-ফোকরগুলো এমন যে যারাই ক্ষমতায় যায় তারাই স্বৈরশাসক হয়ে ওঠে, আমাদের এই ফাঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করতে হবে।’’ ছাত্র-জনতার মহা-অভ্যুত্থানে দেশের রাজনীতির যে পালাবদল ঘটেছে, তারপর এখন এই সিস্টেমের পরিবর্তনটা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে জরুরি।
অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি করে দরকার। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব সময় রাজনীতি সচেতন, বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সংগ্রাম সব ক্ষেত্রে এই শিক্ষার্থীরাই পথ দেখিয়ে এসেছেন। সেটা আরও একবার করে দেখালেন তাঁরা, তাই শিক্ষাঙ্গনকে যাঁরা রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করতে চান, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। যেটা দরকার, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র শাখার দৌরাত্ম থেকে শিক্ষাঙ্গনকে রক্ষা করা। একই কথা প্রযোজ্য শিক্ষকদের রাজনীতির অধিকারের প্রশ্নেও।
নতুন এই বাস্তবতা আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। এখন নতুন করে ঠিক করতে হবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে চলবে কোন পদ্ধতিতে। তাৎক্ষণিক বিবেচনায় সংকটের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণ আবাসিক চরিত্র নিয়ে; এখানে এখনও শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হয় আবাসিক হলে, সার্টিফিকেটেও লেখা থাকে হলের পরিচয়। কিন্তু নানা বাস্তবতায় হলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত আবাসন হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর দৌরাত্মে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য হলগুলো হয়ে উঠেছিল নিপীড়নের কেন্দ্র। এই অবস্থা থেকে উত্তরণই হওয়া উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।
আশার কথা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়াটাও ঠিক এই রকমই। তারাও চায় না, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কোনও সংগঠন নতুন করে প্রভাব বিস্তার করুক হলগুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাস্তবতা হলো, প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছাড়া এই পরিবর্তন আনা আসলে অসম্ভব। তাই এটাই উপযুক্ত সময় এই পরিবর্তন ঘটানোর। মুখের কথায় তো আর এই পরিবর্তন সম্ভব নয়, এর জন্য চাই বাস্তব, কার্যকর পদক্ষেপ।
আশার কথা হলো, সেই পদক্ষেপের একটা প্রস্তুতি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলের বৈধ শিক্ষার্থীদের একটি অনলাইন ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে, হলের কোন ফ্লোরের তদারকির দায়িত্ব কোন শিক্ষকের সেটাও চিহ্নিত করা রয়েছে এই ডেটাবেজে। আবাসিক শিক্ষকরা ফ্লোর পরিদর্শনে গিয়ে এর কোনও ব্যতয় দেখতে পেলে অনলাইনেই রিপোর্ট করতে পারছেন।
বাস্তবতা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে বিপুলসংখ্যক প্রাক্তন ছাত্র বসবাস করেন, যাদের শিক্ষাজীবন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এরা সকলেই যে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, এমন কিন্তু নয়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে এই অছাত্রদের বিতাড়নের একটি কর্মপন্থা ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক বর্তমান শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বৈধ, কিন্তু হলে আবাসনের আনুষ্ঠানিক সুযোগ পাননি এখনও, তবু হলেই থাকতেন। হলের ‘গণরুম’গুলোতে অবস্থানকারী এই শিক্ষার্থীরাই ছিলেন রাজনৈতিক দলগুলোর দাবার ঘুঁটি। এখন হলগুলোতে এই শিক্ষার্থীদের বৈধভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর যেহেতু এরই মধ্যে একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ড তৈরি করা হয়েছে, তাই ওই ড্যাশবোর্ড ব্যবহার করে খুব সহজেই এ রকম শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
হল ব্যবস্থাপনার আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো ডাইনিং-ক্যান্টিনের মান উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খাবারের দাম এমনিতেই অনেক কম, কোনও রকম ভর্তুকি ছাড়া এই দামে মানসম্পন্ন খাবার পরিবেশন আসলে কঠিনই। তবে তারচেয়েও বড় সমস্যা এসব ক্যান্টিনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব, পয়সা না দিয়ে খাওয়া ও বাকি খেয়ে পয়সা না দেওয়ার প্রবণতা। রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়াতেই এ সব ঘটনা ঘটে আসছিল; সেটা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি খাবারে ভর্তুকি দেওয়াটাও খুব দরকার। হলের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশের আর্থিক সামর্থ্য এমন নয় যে খাবারের দাম বাড়ানো হলে তারা খুব স্বস্তি বোধ করবে। তাই উপযুক্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করতে চাইলে কোনও না কোনও উপায়ে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতেই হবে।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা তো আসলে হতে হবে প্রশাসনিক পর্যায়ে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নিশ্চয়ই পরিবর্তন আসবে। তবে এই পরিবর্তন যদি বরাবরের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের বিচারেই করা হয়, তাহলে আসলে খুব একটা লাভ হবে না। নিকট অতীতে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিচারে পরিবর্তন করতে গিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্ত্বশাসন অর্থহীন হয়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রেও শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হলেই চলবে না, হতে হতে সিস্টেমের পরিবর্তন, উপযুক্ত যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে নেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশও দিতে হবে, নইলে তেমন মানুষেরা দায়িত্ব নিতেও চাইবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিরাজনীতিকরণ করার পক্ষে নই আমি; বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই রাজনীতিসচেতন হবেন; দরকার হলে জাতির ক্রান্তিলগ্নে বরাবরের মতো পথ দেখাবেন রাজনীতির ক্ষেত্রেও। কিন্তু বর্তমানের মতো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি পরিহার করাই উচিৎ। তাই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও রাজনৈতিক দলভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবশ্যই জরুরি, তবে সে গণতন্ত্র হওয়া উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভোটাভুটির ব্যবস্থা যত কম রাখা যায় ততই মঙ্গল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন হয়ত অপরিহার্য, তবে শিক্ষকদের সবগুলো নির্বাচন বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে একই সঙ্গে আয়োজন করা হতে পারে একটি বিকল্প উপায়।
রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বন্ধ আর নির্বাচনের ব্যবস্থা কমিয়ে আনলে এমনিতেই শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ফাঁক-ফোঁকর অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতে হলে আমাদেরও নিয়োগের পদ্ধতি বদলাতে হবে এবং অবশ্যই যোগ্য শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান, সম্মানী ও পরিবেশ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে সবচেয়ে কম, থাকবে না উপযুক্ত ল্যাবরেটরি-উপকরণ, থাকবে না গবেষণার তহবিল কিন্তু চাইবেন বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিশ্বসেরা, সেটা কখনওই হবে না। এ রকম হলে যোগ্য শিক্ষকদের ধরে রাখাও সম্ভব হবে না।
আমাদের শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়ে এনে দিয়েছে একটা সুযোগ, এই সুযোগে যদি সিস্টেমটা না বদলাতে পারি, শুধু এক্স-এর বদলে ওয়াই-কে চেয়ারে বসিয়ে দেই, তাহলে তাদের এই আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে যেতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]