Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বাসচালকদের আজীবনের বদভ্যাস একদিনেই বদলে দিলেন শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ঢাকার রাস্তায় বুধবার বাসগুলো চলাচল করেছে নিয়ম মেনে। ফলে অযাচিত যানজট সৃষ্টি হয়নি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ঢাকার রাস্তায় বুধবার বাসগুলো চলাচল করেছে নিয়ম মেনে। ফলে অযাচিত যানজট সৃষ্টি হয়নি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of সাজ্জাদ হোসেন

সাজ্জাদ হোসেন

সড়কে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকা বাস কিংবা যেখানে সেখানে রাস্তার মাঝখানে থামিয়ে যাত্রী তোলার দৃশ্য ঢাকার জন্য খুবই পরিচিত। সাধারণ মানুষও বাসচালকদের এই আচরণ দেখেই এতদিন অভ্যস্ত ছিলেন।

এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমগুলো, যাত্রীরাও করেছেন প্রতিবাদ। তবে মেলেনি কোনও ফলাফল।

ঢাকার সেই পরিচিত দৃশ্য এবার বদলে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার শহরের কোথাও অকারণ দাঁড়াতে পারেনি কোনও গণপরিবহন। গাড়িগুলোকে চলতে হয়েছে লেইন মেনে, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রীও তুলতে পারেননি চালকরা।

বাস চালকদের আজীবনের অভ্যাস একদিনে বদলে যেতে দেখে রীতিমতো অবাক বেসরকারি চাকরিজীবী লুৎফর রহমান। আগারগাঁও মোড়ে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, কথায় যেন ঝরে পড়ছিল বিস্ময়।

তিনি জানান, চাকরির প্রয়োজনে রোজ তাকে সাভার থেকে আগারগাঁও আসতে হয়। বাসচালকদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য সবসময় ভুগতে হয়েছে। মাঝরাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তোলার কারণে পড়তে হয়েছে যানজটে।

রিকশা বা সাইকেল, কাউকেই নিয়ম ভাঙতে দিচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

লুৎফর বলেন, “চালকেরা আড়াআড়িভাবে রাস্তার মাঝখানে বাস দাঁড় করিয়ে পুরো সড়ক বন্ধ করে বসে থাকত। ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও এগুলো দেখার যেন কেউ ছিল না। কিন্তু আজ দেখছেন বাসগুলোর অবস্থা! কী সুন্দর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। বাসচালকদের আজীবনের বদঅভ্যাস একদিনেই বদলে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।”

সাভার থেকে আগারগাঁও আসার পথে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মিলেমিশে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে দেখেছেন বলে জানালেন লুৎফর।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহ্ফুজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি বললেন, “আজ বেসরকারি বেশিরভাগ অফিস খোলা, তার ওপর নয়াপল্টনে চলছে বিএনপির সমাবেশ। অন্যসময় এমন দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বাসে থাকা লাগত। কিন্তু আজ শিক্ষার্থীদের কারণে কোনও যানজট নেই।

“শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিল সবাই ট্রাফিক নিয়ম মানলে সড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও যানজট লাগে না।”

আগারগাঁওয়ে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছিল শেরে বাংলানগর সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জিহাদ। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নিজের প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরেই সড়কে দাঁড়িয়েছে। দুপুর ২টার দিকে রোদ আর গরম উপেক্ষা করেই কাজ করতে দেখা গেল তাকে।

জিহাদ জানাল, বেলা ১১টায় এসেছে সে। আরও কিছুক্ষণ থাকবে।

“আমাকে কেউ আসতে বলেনি এখানে, তারপরও এসেছি। সবার সঙ্গে মিলেমিশে একটি ভালো কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত।”

জিহাদসহ অন্যরা যখন সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছিল তখন পাশেই জনসচেতনতামূলক ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. একরামুল হাসান। সেখানে লেখা ছিল, ‘আজকের শিক্ষা হোক প্রতিদিনের অভ্যাস’।

ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন করছেন একরামুল। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আন্দোলনে সফলতা পেয়েছি। এখন এই দেশটাকে গড়ার দায়িত্ব আমাদেরই। তাই দেশের এমন পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। যতটুকু পারি দেশের ভালোর জন্য কাজ করতে চাই।

“সড়কে শৃঙ্খলা মানলে সবারই লাভ। কাউকেই যানজটে আটকে থাকতে হবে না। তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি আমি। যাতে আজকের মেনে চলা আইন কাল আবার কেউ ভেঙে না ফেলে।”

সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীদের কাছে পানিসহ শুকনো খাবার পৌঁছে দিচ্ছিলেন শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র  মো. রিয়াদুল ইসলাম। কেউ পানি বা খাবার চাইলেই সড়কের পাশে স্তুপ করে রাখা বোতল-প্যাকেট হাতে দৌড়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

পানি, কলা, খাবার স্যালাইন, বিস্কুট, ফলের জুস; সড়কে দায়িত্বরত শিক্ষার্থীদের জন্য এসব উপহার দিয়েছেন অনেকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

রিয়াদুল বলেন, “আজ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অসাধারণ ভালোবাসা পাচ্ছি আমরা। সড়কে শিক্ষার্থীদের দেখে ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ পানি দিয়ে যাচ্ছেন, কেউবা দিচ্ছেন খাবার। অনেকে গাড়ি থামিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন, সাধুবাদ জানাচ্ছেন। এমন সব দৃশ্য দেখে পরিশ্রমের কথা ভুলে গিয়েছি আমি।”

তার কাছেই জানা গেল, কেবল ব্যক্তিগতভাবেই নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানও সহায়তা দিচ্ছে। কেউ ছাতার ব্যবস্থা করেছে তো কেউ জুস বা কোমল পানীয় দিয়ে গেছে। পানিসহ নানা ধরনের শুকনো খাবারের সরবরাহ থাকায় শিক্ষার্থীরাও কাজ করতে পারছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে।

শুধু আগারগাঁও মোড়েই নয়, বুধবার সকাল থেকে ঢাকার সব এলাকার সড়কেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিতে সারাদেশে পুলিশের গুলিতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার অভিযোগ।

তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এ খবর প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পথে নেমে এসে উল্লাস করে বিক্ষুব্ধ জনতা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে থানায় আক্রমণ ও পুলিশ সদস্যদের হত্যার খবর আসতে থাকে।

সহিংসতার মধ্যে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবরোধকারীদের দিকে গুলি ছুড়ছিল পুলিশ। ফাইল ছবি

এ অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। ঢলে ঢাকা হয়ে পড়ে ট্রাফিক ও পুলিশবিহীন। সোমবার শহরের নানা অংশ থেকে আসতে থাকে বিশৃঙ্খলার খবর। লুট করা হয় গণভবন, বঙ্গবন্ধু যাদুঘরসহ জাতীয় সংসদের মালামাল। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যালয়, পোড়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও।

ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব নিজেদের উদ্যোগেই কাঁধে তুলে  নেয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আনসার বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তারা।

মোহাম্মদপুরের সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে দেখা গেল স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের।

সেখানে কথা হয় সাতমসজিদ মাদ্রসার শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলামের সঙ্গে। হাসিবুল বলেন, “ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় সড়কে জ্যাম লেগে মানুষ কষ্ট পাচ্ছিল। মানুষের সেই কষ্ট লাঘবে সবার সঙ্গে আমরা মাদ্রাসার ছাত্ররাও সড়কে নেমেছি।”

শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে খুশি অনেক বাসচালকও।

মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের চালক মো. হাসেম বলেন,“ ট্রাফিক পুলিশও কোনও সময় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের জ্যাম কমাইতে পারে নাই। প্রতিদিন মোহাম্মদপুর এলাকা পার হইতেই ঘণ্টাখানেক সময় লাগত। কিন্তু ছাত্ররা আজ জ্যাম লাগারই সুযোগ দেয় নাই। আইজ বুঝলাম সবাই নিয়ম মানলেই রাস্তা ক্লিয়ার রাখা সম্ভব।”    

মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী আবু সিয়াম।

তিনি বলেন, “কোনও যানবাহনকেই উল্টোপথে চলতে দিচ্ছি না আমরা। যারা চলার চেষ্টা করছে তাদের বুঝিয়ে সঠিক পথে পাঠাচ্ছি। গণপরিবহণের চালকদের বোঝাচ্ছি যেখানে সেখানে বাস-অটোরিকশা থামালে যানজট বাড়ে। শুধু চালকদের নয়, যানজট নিরসনে যাত্রী-পথচারী সবাইকেই সচেতন হতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত