সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা।
বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মাজার গেইট দিয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দেয়, সমাবেত কণ্ঠে গানও পরিবেশন করে।
শুরুতে মাজার গেইট এলাকায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের আটকে দিয়েছিল। তবে এক পর্যায়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করে।
প্রায় আধঘণ্টা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থান করার পর মাজার গেইটের সামনে শিক্ষা অধিকার চত্বরে গিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হওয়ায় আগে থেকেই সুপ্রিম কোর্ট ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণ থেকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরাও মিছিল নিয়ে মাজার গেইটের দিকে যায়। কিন্তু তারা যাওয়ার আগেই গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় গেটের বাইরে শিক্ষার্থীরা এবং গেটের ভেতরে আইনজীবীরা বিভিন্ন বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
এক পর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকজন আইনজীবী গেইটের পাশের ব্যারিকেড টপকে শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ভেতরে নিয়ে যান। পরে আইনজীবীদের সঙ্গে শতাধিক শিক্ষার্থী পুলিশের ব্যারিকেড টপকে মাজার গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
এসময় কোর্ট প্রাঙ্গণের সড়কে বসে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এ সময় আইনজীবী ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন মাহবুব উদ্দিন খোকন, তৈমুর আলম খন্দকার, রুহুল কুদ্দুস কাজল, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মোহাম্মদ আলীসহ অন্যরা। বিক্ষোভ চলাকালে মাজার গেইটের ভেতরে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, গবেষক রেহেনুমা আহমেদ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের বাইরের পরিস্থিতি
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যখন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছিল তখন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে হাইকোর্টের ফটক থেকে পুলিশ চার শিক্ষার্থীকে আটক করে। এর প্রতিবাদে এক নারী শিক্ষার্থী একাই প্রিজন ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে যান।
পরে হাইকোর্টের ভেতর থেকে নারী পুলিশ এসে ওই শিক্ষার্থীকে সরিয়ে নিয়ে যান। এরপর প্রিজন ভ্যানটি চার শিক্ষার্থীকে নিয়ে চলে যায়।
তখনই বেশ কয়েকজন আইনজীবী হাইকোর্টের সামনে উপস্থিত হন। যাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ গুলি চালানো নিয়ে রিট আবেদন করা আইনজীবী আইনুনুনাহার সিদ্দিকা লিপি। তার সঙ্গে ছিলেন মানজুর আল মাতিনসহ আরও কয়েকজন।
মানজুর আল মাতিন সাংবাদিকদের বলেন, “হাইকোর্টের সামনে থেকে এভাবে শিক্ষার্থীদের আটক করা বেআইনি। এই পুলিশদের হাতে আমাদের সন্তান-ভাইদের রক্ত লেগে রয়েছে। এখানে কেউ মিছিলও করেনি। কয়েকজন এসে শুধু জড়ো হয়েছিল। তাতেই আটক করে ফেলা কোনোভাবেই আইনি হতে পারে না।”
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে সেখানে আসেন সাদা দলের শিক্ষকরা। তাদের পেছনে কিছু শিক্ষার্থীও জড়ো হন। তবে তাদের বহরটি শিশু একাডেমি পার হতেই পুলিশ আটকে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলও সেখানে যুক্ত হয়।
সাদা দলের আহ্বায়ক লুতফুর রহমান বলেন, “আমরা সারা বাংলাদেশে শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেছি। আর আমাদের শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না, আর গুলি চালানো যাবে না। আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।”
পুলিশ সেখান থেকে তাদের এগোতে না দেওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানেই বসে স্লোগান দিতে শুরু করেন। সেখানে তারা প্রায় ৩০ মিনিট অবস্থান করেন। তারপর শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে চলে যায়।
অন্যদিকে হাইকোর্টের সামনে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা পুলিশ এবং বিজিবিকে উদ্দেশ্যে করে স্লোগান দিতে থাকে। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক তারা অবস্থান করে।
পরে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত বলেন, “আমাদের মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি সফল। আমরা পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে এই হত্যা আর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করে গেলাম। সারা বাংলাদেশে অনেকেই আজ আমাদের সঙ্গে আছে। সবাই যার যার জায়গা থেকে যে আন্দোলন করছে তাদের প্রতি আমাদের সংহতি।
“কাল সারা বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের কালোর জায়গায় আমাদের আন্দোলনের লাল বেছে নিয়ে তাদের বার্তা জানিয়ে দিয়েছে। শহীদের রক্তের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
তবে এসময় পরবর্তী কোনও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। কর্মসূচি পরে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান নাজিফা।
বারের পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বর্তমান পরিস্থিতিতে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই পক্ষ।
দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এ দুই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
প্রথমে সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপি সমর্থক চারজনের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
পরে সমিতির সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক সরকার সমর্থক ১০ আইনজীবীর উপস্থিতিতে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, “গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় স্বাধীনতা বিরোধী বিএনপি-জামায়াত- শিবিরের দেশ বিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় “
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, আইন-শৃংখলা ও জনজীবন রক্ষায় বদ্ধ পরিকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাই স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।”
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “মেট্রোরেল, সেতুভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের টোলপ্লাজা ও নরসিংদী কারাগারে কারা হামলা চালিয়েছে, তা এখনও কেন চিহ্নিত করা যায়নি? তার কোনও ভিডিও ফুটেজও সরকার প্রকাশ করছে না কেন? কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে, তাও প্রকাশ করা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন তা প্রতিরোধ করতে পারেনি, কেন সরকারি ও বেসরকারি গুরত্বপূর্ণ স্থাপনায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি, সে প্রশ্নের উত্তর সরকার ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিতে পারছে না।”
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “বিচারপতি আবদুল মতিন ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের নেতৃত্বে গঠিত গণতদন্ত কমিশনকে আমরা সর্মথন জানাচ্ছি এবং এই কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য আইনজীবীসহ দেশের সকল নাগরিকদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
“জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে কোটা আন্দোলনে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও আহতদের ব্যাপারে তদন্তের দাবী জানাচ্ছি এবং আমরা মনে করি যে, এই আন্দোলনে শতশত মানুষকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও বেকার যুবক এবং শিশুদের আহত করা হয়েছে এবং সরকার একই কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রেখেছে।”
দ্রুত কারফিউ প্রত্যাহার ও সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবিসহ সকল বিশেষ বাহিনী প্রত্যাহার এবং গণমাধ্যমের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিও জানান তিনি। পাশাপাশি গ্রেপ্তার আইনজীবী ও বিএনপিসহ সকল বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তি দাবি জানান।