রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবিতে উত্তপ্ত এখন বিচারাঙ্গন।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের নিয়ে শনিবার প্রধান বিচারপতির ফুল কোর্ট সভা ডাকাকে ঘিরে উত্তেজনা চলছে।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেখানে যায়।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সোমবার শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। এরপর ওই সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরে নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ ব্যক্তিদের অনেকে পদত্যাগ করেছেন, অনেককে আবার অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতিসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।
এরই মধ্যে শনিবার সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের অংশগ্রহণে ফুল কোর্ট সভা ডাকেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। সকাল সাড়ে ১০টায় ভার্চুয়ালি এই সভা হওয়ার কথা ছিল।
বিষয়টি নিয়ে শনিবার সকাল ৯টার দিকে ফেইসবুকে পোস্ট দেন সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। এই সভা বন্ধ করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আসিফ মাহমুদ বলেন, “ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানা অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সাথে কোনপ্রকার আলোচনা না করে ফুল কোর্ট মিটিং ডেকেছে। পরাজিত শক্তির যেকোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা ইতোমধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে উসকানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে।”
প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “অনতিবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।”
আসিফ মাহমুদ ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সমবেত হতে থাকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
তা দেখে সকাল সোয়া ১০টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ফুল কোর্ট সভা বন্ধ করা হয়েছে।
তারপরও হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বাড়তে থাকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।
এর মধ্যে সকাল ১১টার দিকে আসিফ মাহমুদ ফেইসবুকে আরেকটি পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, “ফ্যাসিবাদের দালালরা এখনও ওঁৎ পেতে আছে ছাত্র-জনতার বিজয় ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। শান্তিপূর্ণভাবে হাইকোর্ট ঘেরাও করছে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা। এখনও সময় আছে শান্তিপূর্ণ পদত্যাগের। অন্যথায় আমরা কঠোর হতে বাধ্য হব।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছে, তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে এই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবে তারা।
এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফেইসবুকে আরেকটি পোস্ট দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, যেখানে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারকের পদত্যাগ দাবি করেন।
তিনি লিখেছেন, “ফ্যাসিস্ট হাসিনা কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতিসহ অ্যাপিলেট ডিভিশনের ৭ জন বিচারপতির পদত্যাগ চাচ্ছি আমরা।”
তাদের এই দাবি সঙ্গে জলা জজ কোর্টের কোনও সম্পর্ক নেই জানিয়ে পোস্টে আসিফ আরও লিখেছেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনের সকলের প্রতি আহ্বান– কোনও জেলায় জজ কোর্টের দিকে অবস্থান নেবেন না। বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই, আমাদের দাবি ও কর্মসূচি স্পষ্ট। শান্তিপূর্ণভাবে শুধুমাত্র হাইকোর্টের আশেপাশে অবস্থান নিন।
“পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে এবং দেশ গঠনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন।”
প্রধান বিচারপতি পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- দুপুর দেড়টার দিকে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শিক্ষার্থীরা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যায়।
যা বললেন আইন উপদেষ্টা
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চেয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, গণআন্দোলন থেকে পদত্যাগের দাবি উঠলে সেই দাবিকে কতটা সম্মান দেখাতে হয়, তা প্রধান বিচারপতি বুঝবেন বলেই তিনি প্রত্যাশা করেন।
পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে পদত্যাগ করার আহ্বান আসার পর প্রধান বিচারপতির কী করা উচিৎ, তা তার ওপরই ছেড়ে দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
এদিকে, নিম্ন আদালতের ক্ষতি না করার আহ্বান জানিয়ে আসিফ নজরুল ফেইসবুকে লাইভে এসে বলেন, “দেশের কিছু এলাকাতে, অর্থাৎ জেলার যে আদালতগুলো রয়েছে, সেখানে ঘেরাও হয়েছে– এ ধরনের ডিসটার্বিং খবর পেয়েছি।”
আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আসিফ নজরুল বলেন, “তাদের কাছে অনুরোধ করব– কোনও অবস্থাতেই জেলার কোনও আদালতে ধ্বংসযজ্ঞ বা নাশকতামূলক কাজ করবেন না এবং সেখানে ঘেরাও করারও প্রয়োজন নাই।
“আমি যতদূর জানি, আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে যে প্রত্যাশা ছিল– উচ্চ আদালতের অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং কিছু বিচারকের পদত্যাগের বিষয়ে। নিম্ন আদালতের ব্যাপারে তাদের কোনও কর্মসূচি নাই। আপনারা কোনও অবস্থাতেই নিম্ন আদালতের কোনও ক্ষতি করবেন না।”
ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা যে কোনও মূল্যে আমাদের এই আদালত ব্যবস্থাকে, নিম্ন আদালতে যারা বিচারক আছেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন, ভবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন।
“যারা উচ্ছৃঙ্খল জনতা রয়েছে, তাদেরকে বুঝিয়ে শান্ত করবেন। আপনারা প্লিজ আমার এই আহ্বান শুনবেন এবং সবাইকে এটা জানাবেন।”