ঈদ এলে প্রতিবছরই কিছু না কিছু ভোগান্তির খবর উঠে আসে সংবাদপত্রের পাতায়। কখনও সেই ভোগান্তির হয় মহাসড়কে খানাখন্দের জন্য তো কখনও যানজটের কারণে। কিছু ভোগান্তি আবার মানুষের তৈরি, যেমন সময়মতো বাস না ছাড়া কিংবা টিকেট কালোবাজারি, অকারণ দাম বাড়িয়ে দেওয়া।
এসব ভোগান্তির খুব সাধারণ চিত্রই আমাদের সামনে উঠে আসে। দীর্ঘসময় বাস টার্মিনালে বা মহাসড়কে অপেক্ষা, টার্মিনালভর্তি মানুষ, কান্নারত শিশুর ছবি কিংবা ক্লান্ত হয়ে ব্যাগের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ছবি দেখেও নাগরিক চোখ অভ্যস্ত।
প্রতিবারই ঈদযাত্রায় আলাদা ভোগান্তিতে পড়ে নারী-শিশুরা। বিশেষ করে যারা সচরাচর এসব ভিড়-ভাট্টায় অভ্যস্ত নয়,তারা পড়ে যায় বিপাকে।
শুক্রবার বিকালে গাবতলী বাস টার্মিনালের সাহেব ফাতে আলী পরিবহনের কাউন্টারের সামনে চোখে পড়ে এক নারীকে কেন্দ্র করে জটলা।
এগিয়ে যেতেই দেখি, বিলাপ করে কাঁদছেন মাঝবয়সী এক নারী। জানা গেল, ভিড়ের সুযোগে কিছুক্ষণ আগেই তার গলা থেকে ছিনতাই হয়েছে সোনার চেইন। ঈদের দুদিন আগে চেইন খোয়া যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আছিয়া বানু নামে অপেক্ষমান এক যাত্রী। তার সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার।
তিনি ছিনতাইয়ের জন্য কান্নারত ওই নারীর অবহেলাকেও দায়ী করলেন। বললেন, “ঈদে এসব হবেই। আমি তো কান-হাত-গলা খালি করে সেগুলো ব্যাগে নিয়া নিছি। নিজের তো সচেতন থাকতে হবে। আর জিনিস যাওয়ার থেকেও রিস্ক হলো জীবনের। এই যে গলা থেকে চেইনটা টান দিলো, বড় বিপদও তো হইতে পারত। জিনিস গেলে পাওয়া যাবে, জীবন তো আর পাওয়া যাবে না।”
দুপুরের পর থেকে গাবতলীতে ছিল টিকেট বা বাস প্রত্যাশী যাত্রীদের ভিড়। এদের বেশিরভাগই অগ্রিম টিকেট কাটতে না পেরে সরাসরি টার্মিনালে চলে এসেছেন, যদি কোনও ব্যবস্থা হয় এই আশায়। কেউ ছুটছেন টিকেটের সন্ধানে তো কেউ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত বাসগুলোয় গিয়ে অনুরোধ করছেন সেখানে তুলে নেওয়ার।
অপেক্ষা আর ছুটোছুটির এই সময়ে সবচেয়ে বিপাকে নারী ও শিশুরা। দীর্ঘসময় গরমে অপেক্ষা করা, প্রয়োজন অনুযায়ী টয়লেট খুঁজে না পাওয়া, অনিশ্চিত যাত্রা; সব মিলিয়ে অস্থির হয়ে পড়তে দেখা গেল শিশুদের।
দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুলনার বাসের টিকিট কাটতে সকাল ৭টায় গাবতলী এসেছেলেন বিউটি আক্তার।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বাড়ি যাব কিনা শিওর ছিলাম না। তাই আগে টিকেট কাটি নাই। সকালে এসে শুনি টিকেট নাই। আমার হাজব্যান্ড মালয়েশিয়া থাকে। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে একাই যাব। কাউন্টার থেকে বলল বিকেলে একটা বাস আছে, সামনে বসে যেতে পারলে উঠায় দেবে। যদিও সেটার জন্য সিটের ভাড়ার থেকেও বেশি টাকা নিছে। কিন্তু যাইতে তো হবেই। এদিকে এই দুই বাচ্চা জ্বালাতন করতেছে। সকাল থেকে বসা, কী আর বলবো। সামনে তো আবার কয়েক ঘণ্টার জার্নি বাকি।”
মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তার ফুটপাতে একটি শিশুকে নিয়ে বসে থাকতে দেখি এক নারীকে।
কথা বলতেই জানা গেল, শিশুটির নাম সুমাইয়া। তার মায়ের নাম জান্নাত বেগম।
জান্নান জানালেন, তার স্বামী টিকেটের জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনোভাবেই টিকেট মিলছে না। তাই তারা মা-মেয়ে ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছেন।
জান্নাত আর তার স্বামী আকাশ মোল্লা পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন বলে শ্বশুরবাড়িতে এখনও জান্নাতের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এখন যদি টিকেটের কারণে ঈদে বাড়ি যেতে না পারেন, তাহলে পরিবারের আরও বিরাগভাজন হতে হবে, জান্নাতের একমাত্র ভয় এখন এটাই।
জান্নাতের সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে সেখানে আসেন আকাশ মোল্লা।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক চেষ্টা করলাম টিকেটের, পাইলাম না। দেখি ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা যাওয়া যায় কিনা। আমাদের জন্য তো সুবিধা। যেভাবে খুশি চলে যাইতাম। বউ-বাচ্চাসহ তো আর সেইটা পারতেছিনা।”
একা হলে কীভাবে যেতেন, সেই প্রশ্ন করি আকাশকে। জবাবে বলেন, “এই ধরেন পুরুষ মানুষ ট্রাকে কইরা চইলা যায়, দরজায় ঝুইলাও চইলা যাইতে পারি। ছোট বাচ্চা নিয়া তো আর সেই সুযোগ নাই।”