সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে নাগরিক সংগঠন সুজন। তাদের প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি এর মেয়াদ ছয় মাস করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এর আগে যখন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ছিল, তার মেয়াদ ছিল তিন মাস। এই সরকারের কাজ রুটিন দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিস্তৃত করার সুপারিশ করেছে সুজন। সেজন্যই মেয়াদ ছয় মাস করার প্রস্তাব করছে সংগঠনটি।
সংসদের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করা, দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিধান সংবিধানে যোগ করার সুপারিশও করেছে সুজন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করেছে।
আলী রীয়াজ নেতৃত্বাধীন সেই কমিশনের কাছে বুধবার লিখিত প্রস্তাব জমা দেয় সুজন। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রস্তাবটি জমা দেন, যিনি নিজে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
সুজনের নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকারও এসময় উপস্থিত ছিলেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রিয়াজের সঙ্গে ছিলেন কমিশনের অন্য সদস্যরা।
তত্ত্বাবধায়ক ও সংসদ
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল। তিন মাসের সেই নির্দলীয় সরকারের কাজ ছিল নির্বাচন করা। সেই সরকারের প্রধান হতেন গঠিত হওয়ার আগের সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখে, যে নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ।
সুজন আগের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সুপারিশ করলেও এতে বিচার বিভাগকে যুক্ত না করার সুপারিশ করেছে।
সংসদের আসন সংখ্যা ৫০টি বাড়িয়ে ৪০০টি করার প্রস্তাব করেছে সুজন। তার মধ্যে ১০০টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার সুপারিশ করেছে।
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করে সংগঠনটি। উচ্চকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের কথা বলেছে।
জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছরের পরিবর্ষে ৪ বছর করার সুপারিশ করেছে সুজন।
স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করার সুপরিশ করেছে সংগঠনটি।
পদের মেয়াদ-ভারসাম্য
কেউ দুই বারের বেশি যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, তা সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ করেছে সুজন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করার কথাও বলেছে সংগঠনটি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে যাওয়ার পথ খোলার সুপারিশ করেছে সুজন। তবে আস্থাভোট ও বাজেট পাসের ক্ষেত্রে ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ রাখার পক্ষপাতি সুজন, অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা চায়, দলের প্রস্তাবের সমালোচনাসহ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটদানের সুযোগ যেন উন্মুক্ত থাকে।
নির্বাচন
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়টি রাজনৈতিক দলসহ সচেতন নাগরিকদের আলোচনায় জোরেশোরে এসেছে।
সুজন মনে করে, ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা যায় কি না, তা নিয়ে এখনই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।
সম্পূর্ণরূপে আনুপাতিক পদ্ধতি না কি মিশ্র পদ্ধতি- এই প্রশ্নের মীমাংসা করে সুজনের প্রস্তাব, মিশ্র পদ্ধতির ক্ষেত্রে সমগ্র দেশকে ২০০টি আসনে ভাগ করে উক্ত আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচন এবং অবশিষ্ট ২০০ টি আসন ভোটপ্রাপ্তির শতকরা হার অনুযায়ী বণ্টন করা যেতে পারে।
তারা আরও বলেছে, সমগ্র দেশকে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করেও ইউনিটভিত্তিক ভোট প্রাপ্তির অনুপাতে আসন বণ্টন করা যেতে পারে। সাধারণ আসন ও সংরক্ষিত আসনের জন্য পৃথক প্রার্থী তালিকা অগ্রাধিকার অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে প্রণয়ন করা যেতে পারে।
মনোনয়ন বাণিজ্য পরিহারসহ কর্তৃত্ববাদের অবসানের জন্য বিশেষ সম্মেলন আয়োজন করে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতিতে আয়োজনের পক্ষপাতি সুজন। জেলা পরিষদ নির্বাচন মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে না করে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে করার সুপারিশ করেছে তারা।
পুরুষতান্ত্রিক শব্দ বাদ দেওয়া
দেড়ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দেশের বর্তমান সংবিধানে থাকা পুরুষতান্ত্রিক ভাষা ও শব্দ বাদ দেওয়ার পক্ষে মত জানিয়েছে সুজন।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেমন রাষ্ট্রপতি; পতি অর্থ স্বামী, আমরা চিন্তাই করি নাই যে নারী রাষ্ট্রপতি হতে পারে। সংবিধান সামন্ততান্ত্রিক যেমন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কেন হবে? এটা জনগণতান্ত্রিক করার পরামর্শ দিয়েছি।”
জাতিগত সংখ্যালঘু সব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতিসহ সংবিধানকে প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের দলিলে পরিণত করার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর নারীর জায়গায় চলে আসছে আরমা দত্ত, মমতাজরা। এরা তো আরবান। এটাকে আরও ইন্টারসেকশনালি করার পক্ষে বলে এসেছি। যাতে দলিত, চা বাগানের শিক্ষিত নারীরা জায়গা পায়। যাতে প্রত্যেকটা জায়গার প্রতিনিধিত্ব হয়।”
“সংবিধানে বহুত্ববাদের প্রতিফলন নাই। দেশে অন্তত ২৭টা জাতির নাম যেন সংবিধানে লেখা থাকে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
সংস্কার কীভাবে হবে
সাংবিধানিক এক সংকটের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে এরই মধ্যে।
সুজন বলছে, যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংবিধান সংশোধনের সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সেই সমঝোতা স্মারকে এমন শর্ত থাকবে, যে দলই পরবর্তীকালে ক্ষমতায় যাক, তারা সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেবে এবং বিরোধী দলগুলোও তাতে সমর্থন দেবে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল সংবিধানকে সমুন্নত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে সুজন।
তারা বলেছে, জনস্বার্থে সংবিধান সংশোধন হতেই পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত একটি বিষয় সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকবে, তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।