সামিট গ্রুপের ১৯১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত, যেগুলোতে ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬০ টাকা রয়েছে।
ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, তার পরিবার এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের নামে খোলা ব্যাংক হিসাব জব্দে রবিবার আদেশ দেয় ঢাকার জজ আদালত।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান রয়েছেন সিঙ্গাপুরে। তার ভাই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত দেড় দশকে কারা কারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তার অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সেই অনুসন্ধানে সামিট গ্রুপও রয়েছে জানিয়ে দুদকের উপপরিচালক আলমগীর হোসেন এই শিল্প পরিবার সংশ্লিষ্ট ১৯১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, সামিট গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানকালে তাদের নামে সঞ্চয়ী, এফডিআর ও অন্যান্য হিসাবসমূহের তথ্য পাওয়া যায়। এসব হিসাবসমূহে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে।
“এসব হিসাবসমূহে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। যেকোনো সময় এসব অর্থ উত্তোলনপূর্বক বিদেশে পাচার/গোপন করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে মর্মে অনুসন্ধানকালে প্রতীয়মান হয়।”
এই কারণ দেখিয়ে দুদক কর্মকর্তা আবেদন করলে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অবকাঠামো, তথ্য প্রযুক্তি, জাহাজ পরিচালনাসহ নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা ব্যবসায় নিয়ে সামিট গ্রুপের সম্পদমূল্য কমপক্ষ ২৫০ কোটি ডলার। ফোর্বসের করা সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় এই গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানের নাম রয়েছে।
আজিজ খানের ভাই ফারুক খান গোপালগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক খান ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সরকারে প্রথম মন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর পুনরায় মন্ত্রী করেন তাকে। তার আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও হন তিনি।
ওই বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন মাস পর অক্টোবরে গ্রেপ্তার হন ফারুক খান। অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত বিভিন্ন হত্যামামলায় আসামি হয়ে এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন।
নাবিল গ্রুপের ৯৮ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ
আদালতের আরেক আদেশে নাবিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম, তার পরিবারের সদস্য এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ৭৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করতে বলা হয়। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৯৮ কোটি ৯৪ লাখ ১৭ হাজার ২৮০ টাকা আছে।
ঢাকার বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের পাশাপাশি নাবিল গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ৫৯ দশমিক ১৪৩৬৫ একর জমি জব্দের আদেশও দিয়েছেন রবিবার। জব্দ সব জমিই রাজশাহীর পবা থানার বীরগোয়ালীয়া মৌজার।
দুদকের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান নাবিল গ্রুপের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ এবং সম্পদ জব্দের আবেদনটি করেছিলেন।
আবেদনে তিনি বলেন, নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা ও সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে জাল জালিয়াতি, প্রতারণা ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক হতে ঋণ নিয়ে আত্মসাত ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ না করলে এই অর্থ তুলে পাচার করা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন দুদক কর্মকর্তা।
স্থাবর সম্পদ জব্দের আবেদনে তিনি বলেন, জব্দ করা না হলে এসব স্থাবর সম্পদসমূহ যেকোনোভাবে বিক্রয় বা হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে।
সিকদারদের ৪২ বিও হিসাবও অবরুদ্ধ
ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নুল হক সিকদার এবং তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন ৪২ বিও হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশও দিয়েছেন ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব।
দুদকের সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমানের আবেদনে রবিবার এই আদেশ দেন তিনি।
আবেদনে বলা হয়, সিকদার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নামে-বেনামে জনগণের আমানতের অর্থ লুটপাটসহ ঘুষের বিনিময়ে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দেওয়া ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিকদার পরিবারের সদস্য কর্তৃক জনগণের আমানতকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান ও আত্মসাতের তথ্য পাওয়া যায়।
গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৫০৬তম সভার নির্দেশনা অনুযায়ী সিকদার পরিবার ও সংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক এবং এনবিএল সিকিউরিটিজের ধারণকৃত শেয়ারের তালিকা প্রেরণ করা হয়। ওই শেয়ারগুলো হস্তান্তর স্থগিত/ব্লক করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যাংক ও ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্যাংক থেকে অনুরোধ জানানো হয়।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, “প্রাপ্ত তথ্য মতে বর্তমানে সিকদার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন। বিদেশে থেকে তারা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শেয়ারগুলো বিক্রি/স্থানান্তরের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। যেহেতু এসব বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সিকদার পরিবারের সদস্য এবং তাদের নিকট আত্মীয়দের নামে অর্জিত শেয়ারগুলো বিক্রি/স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য এসব বিও অ্যাকাউন্টগুলো অবিলম্বে অবরুদ্ধ করা একান্ত আবশ্যক।”



