সাড়ে চার মাস পর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহকারী সামিটের টার্মিনালের কারিগরি ত্রুটি সারানো হয়েছে। গ্যাস সংকট সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকার ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টার্মিনাল চালুর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল।
তার আগেই বুধবার কক্সবাজারের মহেশখালীতে সামিটের টার্মিনাল এলএনজি সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২৭ মে কারিগরি ত্রুটিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া সামিটের টার্মিনালের সরবরাহ লাইনের পরীক্ষামূলক কাজ নানা জটিলতা পেরিয়ে মঙ্গলবার শেষ হয়।
তবে পেট্রোবাংলার কাছে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় সামিটের টার্মিনাল ব্যবহার করে বাড়তি এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই সপ্তাহ থেকে বাড়তি গ্যাস পাওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, সেটি পূরণ হচ্ছে না।
সরকার দুইভাবে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে। একটি সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে। আরেকটি তালিকাভুক্ত বিদেশি ২৩টি কোম্পানির কাছে থাকা স্পট মার্কেট থেকে।
চুক্তিভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহ নিয়ে সমস্যা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তারা বলছে, কাতারের রাস গ্যাস থেকে এ বছর ৪০টি কার্গো জাহাজে করে এলএনজি আনার চুক্তি আছে। জুলাই পর্যন্ত এসেছে ২৪ কার্গো জাহাজ। আর ওমানের ওমান ট্রেডিং থেকে ১৬টি কার্গো জাহাজ আনার চুক্তির বিপরীতে জুলাই পর্যন্ত এসেছে ৯টি কার্গো জাহাজ।
তবে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আগে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে তালিকাভুক্ত ২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে কোটেশন বা দর নিয়েই অনুমোদন দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে দ্রুত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ (বিশেষ) আইন ২০১০ অনুসরণ করা হয়।
এখন সেই ২৩ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
৪ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
ফলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনে কবে নাগাদ তা দেশে পৌঁছাবে, তা নিশ্চিত নয়।
এ অবস্থায় বিদেশের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনে তা দেশে না আসা পর্যন্ত ৬শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে।
মহেশখালীতে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল চালু থাকলে সর্বোচ্চ ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ দিতে পারে পেট্রোবাংলা। তখন গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব অনুযায়ী, তাদের বহির্নোঙরে এখন দুটি এলএনজিভর্তি জাহাজ আছে, ‘নিউ এপেক্স’ ও ‘ইজনান’।
এই দুই জাহাজে ১ লাখ ২৬ হাজার মিলিয়ন টন গ্যাস আছে। সেই এলএনজি আনা হয়েছে জিটুজি ভিত্তিতে কাতারের রাস গ্যাস কোম্পানি থেকে। এই জাহাজ দুটি বরাদ্দ দেওয়া আছে মহেশখালীর আরেক এলএনজি টার্মিনাল এক্সিলারেটের জন্য। সামিটের টার্মিনালে সরবরাহ দিতে গেলে নতুন করে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আনতে হবে।
এ বিষয়ে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ট্রায়াল রান শেষে বুধবার থেকে সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেই টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ দিতে পর্যাপ্ত এলএনজি এখন মজুদ নেই। স্পট মার্কেট থেকে কিনে সেটি আনার প্রক্রিয়া চলছে। ততদিন পর্যন্ত আমরা এক্সিলারেটের একটি টার্মিনাল দিয়েই এলএনজি সরবরাহ দিতে পারব।”
কবে নাগাদ সেই এলএনজি আসবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকারের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত এটি। তবে আমরা জানি, ৪ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”
স্পট মার্কেট থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সর্বশেষ এলএনজি কিনেছিল ৪ জুলাই। এরপর থেকে আর এলএনজি কেনা হয়নি। এ বছরের জানুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত ২১টি জাহাজে এলএনজি আমদানি করে বিগত সরকার।
এলএনজি দেশে আসার বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি কেনা হবে, সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রাইস নেগোসিয়েশন শেষেই সেটি চূড়ান্ত হবে। কবে নাগাদ আসবে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।
“নতুন এলএনজি জাহাজ না আসা পর্যন্ত আমরা বর্তমান টার্মিনাল দিয়ে ৬শ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব। ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেতে স্পট মার্কেটের এলএনজি দেশে আসতে হবে।”
গ্যাস উত্তোলন সরবরাহে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, দেশে দিনে ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার সক্ষমতা আছে প্রতিষ্ঠানটির।
যদিও সেই সক্ষমতা পেট্রোবাংলা কখনই পূরণ করতে পারেনি। ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুটের বদলে পাওয়া যাচ্ছে ২ হাজার ১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
আর আমদানি করা এলএনজির সরবরাহ সক্ষমতা আছে ১১শ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৭ মে থেকে সামিটের টার্মিনাল বন্ধ থাকায় এই সাড়ে চার মাসে সেই সরবরাহ অর্ধেকে নেমেছে।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ মঙ্গলবারের হিসাব অনুযায়ী, দিনে ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া গেছে ২ হাজার ৫৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে এসেছে ৫৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এই এলএনজি কেবল এক্সিলারেট টার্মিনাল থেকে এসেছে।
বাকি গ্যাস এসেছে দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে। দুটি টার্মিনাল যখন চালু ছিল, তখন ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হতো। এই পরিমাণ গ্যাস না পাওয়ায় গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানা, বাসা-বাড়িতে সংকট বেড়েছে।