দেশের চাহিদা সামাল দিতে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কক্সবাজারের মহেশখালীর ভাসমান যে দুটি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ দেওয়া হয়, তার একটি সামিটের টার্মিনালটি কারিগরি ত্রুটি সারিয়ে ১০ জুলাই ফিরেছে। সেটি পাইপলাইনের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে এলএনজি সরবরাহ শুরু করতে ১৮ জুলাই পর্যন্ত লাগতে পারে। এতে গ্যাস সরবরাহ সংকটের উন্নতির আশা করছে গ্যাস উৎপাদন-সরবরাহে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা।
এখন মহেশখালীর একটি টার্মিনাল ‘এক্সিলারেট এনার্জি’ দিয়ে দিনে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। সামিট চালু হলে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ হবে। আর দুটি টার্মিনাল মিলিয়ে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে দেশের মোট গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়নে উন্নীত হওয়ার কথা।
এই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হলে সংকট অনেকটাই সহনীয় হতো, যদিও বাস্তবে সেটি হয় না। গত তিন মাসের গ্যাস সরবরাহের তথ্য তাই বলছে।
চলতি বছরের মে-জুলাই তিন মাসের মধ্যে ২০ মে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সেদিন ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল ৩ হাজার ১১৫ মিলিয়ন ঘনফুট। সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণ ৮১ শতাংশ। তবে মে মাস পুরোটাই গড়ে প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ৮৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, জুন মাসে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে। জুন মাসে গড়ে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৪৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট। সক্ষমতার বিপরীতে এর পরিমাণ ছিল ৬৫ শতাংশ। আর পুরো জুন মাসজুড়েই এলএনজির একটি টার্মিনাল বন্ধ ছিল। ঘুর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব ও সামিটের টার্মিনাল বার্জ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মে মাসের তুলনায় জুনে সরবরাহ কমেছে।
জুলাই মাসের ১১দিনে গড়ে প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৫৫৮ মিলিয়ন ঘনফুট। সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের হার ছিল ৬৬ শতাংশ। জুলাই মাসে এলএনজির একটি টার্মিনাল বন্ধ ছিল। আবার এলএনজি সরবরাহের দুটি পাইপলাইনের মধ্যে একটি দিয়ে এলএনজি গ্যাস সরবরাহ তিন দিন বন্ধ ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্যাস সরবরাহ কম ছিল।
মুলত এলএনজি আমদানি-সরবরাহ কার্যক্রমে কোনও ত্রুটি হলেই গোটা দেশেই গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয়ে পড়ে। কারণ, এলএনজির বিপরীতে সরকার গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাড়তি গ্যাস উত্তোলন করতে পারে না। এরফলে আবাসিকে সংকট না থাকলেও শিল্প কারখানা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সংকট রয়েই যাচ্ছে।
এলএনজি সরবরাহ সক্ষমতার পুরোটা দিলে সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কিন্তু সংকট একেবারে কাটবে না। কবে নাগাদ এই সংকট কাটবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সামিটের এলএনজি সচল করা হচ্ছে। চালু হতে সপ্তাহখানেক লাগবে। সেটি চালু হলে আমরা এলএনজি এবং দেশিয় গ্যাস মিলিয়ে মোট ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ দিতে পারব। এখন আমরা ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো দিচ্ছি। সেটি দেওয়া গেলে গ্যাস সংকট অনেকটাই কমে আসবে।”
কিন্তু সক্ষমতার সমপরিমাণ গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না কেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নানা কারণে সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেই এর উত্তর মিলবে।”
দেশি গ্যাসক্ষেত্রের সরবরাহ কম
পেট্রোবাংলার হিসাবে, দেশে মোট গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে দেশের ১১৬টি কূপ থেকে গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার সক্ষমতা আছে ২ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন ঘনফুট। বাকি ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি হিসেবে আমদানি করেই সরবরাহ দেওয়া হয়। এরমধ্যে এলএনজি সক্ষমতার পুরোটাই দেওয়ার অনেক নজির আছে। কিন্তু দেশি কূপগুলো তাদের সক্ষমতার পুরোটা দিতে পেরেছে এমন নজির নেই।
গত তিন মাসের পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, শুধু ২৩ মে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ সর্বোচ্চ দেওয়া হয়েছে; যার পরিমাণ ২ হাজার ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট। সক্ষমতার বিপরীতে সরবরাহের হার ছিল সাড়ে ৮১ শতাংশ। মে মাস থেকে পরবর্তী জুন ও জুলাই মাসে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ ক্রমান্বয়ে কমেছে।
ফলে জুন মাসের শুরু থেকে এলএনজির একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকার সময়ও দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ বাড়েনি। এই দেড় মাস এলএনজি এবং দেশি গ্যাস মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিতে পেরেছে পেট্রোবাংলা। ফলে গ্যাস সংকট বাড়ছিল।
গত ৯ জুলাই সন্ধ্যায় এলএনজি সরবরাহের আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পাইপলাইনে দুর্ঘটনা ঘটলে ৬৩ ঘণ্টা এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকে আর এতে গ্যাস আরও প্রকট হয়।
মে মাসে যেখানে ৩ হাজার ১১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছিল, সেখানে এখন দেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গ্যাস সরবরাহ কমায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে। এতে দেশজুড়ে লোড শেডিং বেড়েছে। এমনকি তাপমাত্রা কমে বিদ্যুতের চাহিদা কমার পর লোড শেডিং না কমে উল্টো বেড়েছে। আর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পেয়ে সার কারখানা বন্ধ থাকছে। বেশি দামে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শিল্পকারখানাগুলো গ্যাস পায়নি, এতে তারা উৎপাদন কমিয়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্পগ্রুপের প্রধান নাম না প্রকাশের শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলছেন, “বাড়তি টাকা দিয়ে যে চাহিদামতো গ্যাস পাব না, সেটি বুঝতে আমাদের একবছর লেগেছে। এখন আমরা বুঝে গেছি খুব শিগগিরই গ্যাস সংকটের সমাধান মিলবে না। এখন আমরা কারখানার উৎপাদন বাড়াতে চাইলে হয় বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে, না হয় উৎপাদন কাটছাঁট করতে হবে। এটি ছাড়া আপাতত সমাধান দেখছি না।
“টাকা খরচ করে বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করলে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি সরবরাহ সক্ষমতা এখনও গড়ে উঠেনি। সেটি তৈরি হতে ২০৩০ সাল নাগাদ লাগবে। ফলে আমরা ততদিন পর্যন্ত কীভাবে সামাল দেব, সেটি নিজেদেরই উপায় বের করতে হবে।”
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাক বলেন, “গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ থাকলেও গত একমাস ধরে দেওয়া হচ্ছে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
“এতে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সংকট সামাল দিতে সরকারকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি ঝুঁকতে হচ্ছে। খরচ কমাতে তেলভিত্তিক উৎপাদনে নজর কমিয়েছে। এর ফলে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না।”