নানা হুমকি এর আগেই পেয়েছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন; কিন্তু তা গোনায় ধরেননি। এবার থানায় গিয়েছেন, সাধারণ ডায়েরি করেছেন। যাতে স্পষ্ট হয়েছে, এবারের হুমকিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
কিন্তু কারা, কী কারণে তাকে হুমকি দিচ্ছে? তা খোলসা করেননি এই সংসদ সদস্য। তবে বলেছেন, তাকে হত্যা করতে চার-পাঁচজনের খুনি ভাড়া করা হয়েছে বলে জেনেছেন তিনি। আর তথ্যটি পেয়েছেন তার এলাকার পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে, তাই একে উড়িয়ে দিতে পারছেন না তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, যুবলীগের কমিটিতে স্থান নিয়ে এক ধরনের পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন সুমন। তবে তা ছাপিয়ে যায় সোশাল মিডিয়ায় তার সরব উপস্থিতি।
আর তার ওপর ভর করে এই বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মন্ত্রী মাহবুব আলীকে লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হন ৪৪ বছর বয়সী সুমন।
সংসদে প্রথম যাওয়ার পরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব সুমন। এর মধ্যে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদের অনুসন্ধান চেয়ে দুদকে আবেদন করেছেন, এনবিআরের বিতর্কিত সদস্য মতিউর রহমানকে নিয়ে কথা বলেছেন।
এসবের মধ্যেই শনিবার রাতে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন সুমন; তাতে তিনি বলেন, প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি।
সংসদ সদস্য সুমনের এমন জিডির পর সোশাল মিডিয়ায় চলছে আলোচনা; তিনি নিজে ফেইসবুকে কথা বলেছেন, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও।
সেখানে তিনি তার এলাকার এক সময়ের সংসদ সদস্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং সম্প্রতি ভারতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গও তুলে তিনি বলেন, খুন হয়ে যাওয়ার পর কোনও পদক্ষেপই কোনও ব্যক্তিকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে না।
জিডি করার পরদিন সুপ্রিম কোর্টে একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুমন বলেন, “পাবলিকলি এর আগে অনেকে হুমকির কথা বললেও সেটা তিনি আমলে নেননি। তবে এইবার আমার থানার ওসি সাহেবকে কেউ জানিয়েছে যে একটা থ্রেট আছে…চার-পাঁচজনের একটা কিলার গ্রুপ, কন্ট্রাক্ট কিলার, কন্ট্রাক্ট করে আসছে এবং উপরে কিছু লোকজন আছে, যারা তাদেরকে হায়ার (ভাড়া) করছে।
“যেহেতু ওসি সাহেব আমাকে জানিয়েছে এবং ওই লোকের সঙ্গে আমাকে ফোন দিয়ে কথাও বলায় দিছে, সেই লোকটি সিলেটি এবং আমার নাম শোনার পর…হত্যাকাণ্ডের লিস্টে আমার নাম শোনার পর, সেই জায়গা থেকে চলে আসছে, এটা তার (ওই ব্যক্তির) দাবি।”
এই ধরনের হুমকির কথা জানার পরও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ এই সংসদ সদস্য।
তার মনে হচ্ছে, কেউ কেউ চায় না যে তিনি বেঁচে থাকুন।
সুমন বলেন, “দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ওসি সাহেব খবরটা পেয়েছেন দুই দিন আগে। ওনার তো তৎক্ষণাৎ এসপি সাহেবকে জানায়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল। আমাকে এসে জিডি করা লাগল কেন?
“একমাত্র আইজিপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার পর …. একমাত্র উনি কিন্তু আমার মতোই চিন্তা করছেন যে এটা তো জিডি করার প্রয়োজন নেই, এটা তো পুলিশেরই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।”
সুমনকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার ওসি হিল্লোল রায়। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুক্রবার এমপি স্যার চুনারুঘাট ছিলেন। একজন ব্যক্তি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমি স্যারকে বিষয়টি অবহিত করি। ওই ব্যক্তি স্যারকে তার নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন। আমি বিষয়টি এসপি স্যারকেও তাৎক্ষণিক অবহিত করি। আমরা এনিয়ে কাজও করছি।”
তবে ওই ব্যক্তির পরিচয় সুমন কিংবা চুনারুঘাটের ওসি কারও মাধ্যমেই প্রকাশ পায়নি।
জিডিতে সুমন লিখেছিলেন, “গত ২৭ জুন ঢাকায় অবস্থানকালে রাত আনুমানিক ২টার সময় আমার নির্বাচনী এলাকার চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার সরকারি মোবাইল থেকে আমার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে জানান, ‘আপনাকে হত্যার জন্য অজ্ঞাতনামা একটি শক্তিশালী মহল গত তিন দিন আগে ৪-৫ জনের একটি টিম নিয়ে মাঠে নেমেছে। আপনি রাতে বাইরে বের হবেন না এবং সাবধানে থাকবেন।’
“তখন আমি ওসির কাছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি ওই ব্যক্তির পরিচয় জানাতে অস্বীকার করেন এবং আমাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দেন।”
সাক্ষাৎকারে সুমন বলেন, সংসদ অধিবেশনের জন্য ঢাকায় ছিলেন তিনি। তখন চুনারুঘাটের ওসি তাকে ফোন দিয়ে কথা বলতে চান। এরপর গত শুক্রবার তিনি হবিগঞ্জ গেলে ওসি তাকে হুমকির বিষয়ে জানান এবং অজ্ঞাতনামা সেই ব্যক্তির সঙ্গেও কথা বলিয়ে দেন। এরপরই বিষয়টি তিনি ‘সিরিয়াসলি’ নেন।
এরপর এলাকায় নিজের সব কর্মসূচি বাতিল করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায় চলে আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় ফিরে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন।
নিরাপত্তাহীনতার কথা সংসদ বা স্পিকারকে জানিয়েছেন কি না- এই প্রশ্নে সুমন বলেন, “গতকাল জিডি করলাম, আজ বাজেট বক্তৃতা চলছে। এখানে স্পিকারকে জানানোর মতো পরিবেশই পাইনি। স্পিকারকে জানালেও তো পুলিশ বিভাগকেই তিনি জানাবেন।”
পুলিশের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে এই আইনপ্রণেতা বলেন, “আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ছিলাম, আমি এখন সংসদ সদস্য। সবকিছু বিবেচনায় আমার নিরাপত্তার যে অবস্থা…আসলে যারা নিরাপত্তা দেন তারা যে কী চাচ্ছেন, এটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
“আমার যদি জিডি করেই জানতে হয় .. পুলিশই তো আমার অগোচরে এগুলো জেনে নেবে আসলে কী থ্রেটটা (হুমকি) রিয়েল (সত্যি) নাকি ফেইক ( মিথ্যা)?”
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “বেনজীরের মতো লোক তৈরি হয়েছে, মতিউরের মতো লোক তৈরি হয়েছে পুলিশের এসব কারণেই।
“যে খবরই পায় না কখন কারে হুমকি দেয়, এইসব কারণেই তো বড় বড় অফেন্সগুলো সংঘটিত হবার পর এরা জিডি করে রাখে। কিন্তু এভাবে ধারাবাহিকভাবে চললে বাংলাদেশের এমনিতেই বারোটা বেজে যাবে।”
“আমার কাছে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু কিছু মানুষ কি আদৌ চাচ্ছেন কি না যে আমি বেঁচে থাকি,” বলেন সুমন।
আনার হত্যার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “সংসদ সদস্য আনার মারা গেল, ফাইনাল কনক্লুশন পাইনি। ডিবি খুব সফলতার সঙ্গে আসামি ধরেছে, কিন্তু তা তো মারা যাবার পর। আমার হয়ত এরকমই হবে, আসামি সব ধরা পড়বে মারা যাবার পর।”
দুই দশক আগে হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় কিবরিয়ার প্রসঙ্গ তুলে সুমন বলেন, “আমাদের এলাকায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া মারা গেছেন গ্রেনেড হামলায়, আমাদের বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাইতে পারি নাই। আমার বিষয়টা এমন হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে একটা অপমৃত্যুর রেকর্ড করার জন্য বসে আছেন লোকজন।”
সুমন তার জীবন নিয়ে নিজে যতটা শঙ্কিত, পরিবার তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত বলে জানান তিনি।
তার ১১ বছরের মেয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি তার মেয়েকে বলেছিলেন, ভালো কাজ করার কারণে খারাপ মানুষেরা তাকে হুমকি দেয়।
“তার ( কন্যা) মাথায়ও তো রয়েছে যে, এদেশে ভালো কাজ করলে, দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে, সেটা একটা স্টুপিডিটি।”
প্রাণ হারানোর ভয়েও নিজের পথ থেকে সরবেন না বলে জানান সুমন। তবে তার শঙ্কা, তিনি মারা গেলে ভালো কাজ করার উৎসাহ হারাবে মানুষ।
“কিন্তু এখন হঠাৎ করে মারা গেলে আনফিনিশড যে জবগুলো রয়েছে বা পরবর্তী প্রজন্ম যেন কোনোভাবেই উৎসাহ না হারায়। এই জন্য আমাকে মেরে ফেললেও দেশও ছাড়ব না এবং আমি আমার কাজও বন্ধ করবো না।”
নিজের নিরাপত্তায় বিশেষ বন্দোবস্ত চান কি না- এই প্রশ্নে সুমন বলেন, “শুধু আমার নিরাপত্তা চাই না। আমি চাই, সব নিরাপদ থাকুক। আমি নিরাপদ থাকলাম, কিন্তু অন্যরা নিরাপদ থাকল না, তাহলে নেতা হয়ে তো লাভ নেই। নিরাপদ হোক পরিবেশ, মানুষ যেন নিরাপদে থাকুক।”