সবশেষ ২২ বছরে সুন্দরবনে ৩২ বার আগুন লেগেছে জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা বলছে, এসব আগুন মানুষের তৈরি এবং পরিকল্পিত। অতি লোভের কারণে সুন্দরবন ধ্বংস করা হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে সংগঠনটি বলছে, সুন্দরবনে আগুন লাগার দায় কোনোভাবেই বনবিভাগ এড়াতে পারে না।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দেলনের (বাপা) উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা উঠে আসে। ‘বারংবার আগুন সন্ত্রাসের কবলে সুন্দরবন : কারণ ও প্রতিকার’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলন থেকে সুন্দরবন রক্ষায় ১৬টি সুপারিশও তুলে ধরা হয়।
বাপার যুগ্ম সম্পাদক নূর আলম শেখ জানান, গত ৪ মে আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তারা। সেই অভিজ্ঞতা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন তিনি।
দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে সুন্দরবন গুরুত্বহীন বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “সুন্দরবনে আগুনের ঘটনায় বনবিভাগ কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। যাদের কাছে সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব, তাদের কাছে আদৌ সুন্দরবন নিরাপদ কিনা তা নিয়েই সংশয় রয়েছে।
“এসব আগুন মানুষের তৈরি এবং পরিকল্পিত। এতে সামগ্রিকভাবে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। বড়গাছসহ লতাগুল্ম মারা যাচ্ছে, প্রাণীকূলের আবাসস্থল ও প্রজননস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে বনের প্রাণীকূলের খাদ্যচক্রে, আঘাত আসছে বাস্তুতন্ত্রে।”
সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও সুন্দরবনে মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে উল্লেখ করে নূর আলম শেখ বলেন, “মুনাফালোভী মাছ ব্যবসায়ী ও অসৎ বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বার বার সুন্দরবনে আগুন লাগানো হচ্ছে।”
সংগঠনের সহ-সভাপতি মহিদুল হক খানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ও বাপার জাতীয় কমিটির সদস্য ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানান, গত ২২ বছরে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২ বার আগুন লেগেছে। পুড়ে ছাই হয়েছে শতাধিক একর বনভূমি। এসব ঘটনার জন্য কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবকে দায়ী করেন তিনি।
মহিদুল হক খান বলেন, “দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সমন্বয় না হলে দেশের বন-পরিবেশ কোনোটাই নিরাপদ না। অথচ এসব রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।”
আলোচনায় উঠে আসে রামপাল তাপ বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রসঙ্গও।
সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বাতিলের দাবি জানান মহিদুল খান।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও শিল্প কারখানা স্থাপন করা যাবে না। অথচ সেখানে রামপাল তাপ বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বনের যে অবস্থা তাতে ঘন জঙ্গলের পরিমাণ অবশিষ্ট আছে আর মাত্র ১৩ শতাংশ।
২০১৭ সালে রামপাল বিষয়ক ১৩টি গবেষণাপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু গত সাত বছরেও সরকার পক্ষ থেকে কোনও মতামত দেওয়া হয়নি। অথচ এখন সুন্দরবন রক্ষায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার অভিযোগ করে বলেন, সুন্দরবনে গবেষকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে বন ধ্বংসকারীদের অবাধে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সুন্দরবন রক্ষায় ১৬টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ও অগ্নিকাণ্ড বন্ধে বনবিভাগ, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, নৌপুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, সংবাদকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় সংগঠনকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন, অতীতের বিভিন্ন আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন, বনে অবাধ যাতায়াত বন্ধ, বনের মধ্যে অপরিকল্পিত খাল খনন বন্ধ, সুন্দরবন রক্ষায় অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি প্রনয়ণ।