সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালনে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি।
তারা হলেন- বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।
তারা এতদিন হাইকোর্ট বিভাগে বসতেন। এখন আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ পাঁচ বিচারকের সঙ্গে বসবেন।
বুধবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে নতুন তিনজনকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হয়। তাতে বলা হয়, সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত তিনজন বিচারককে তাদের শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করেছেন।
এই তিনজনের শপথ অনুষ্ঠান হবে বৃহস্পতিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে হবে বলে আদালত প্রশাসন জানিয়েছে।
নতুন তিনজনকে নিয়ে আপিল বিভাগে এখন বিচারকের সংখ্যা দাঁড়ালো আটজনে। প্রধান বিচারপতি বাদে অন্যরা হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।
এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে তিন বিচারককে নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। দেড় বছর বাদে নিয়োগ পেলেন তিনজন। অবসরের বয়স বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, আগামী এক বছরকাল একসঙ্গে অন্তত সাতজন বিচারক কাজ করবেন আপিল বিভাগে।
আপিল বিভাগে বিচারক সংকটে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিভিউ আবেদন, পিলখানা হত্যা মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলা ঝুলে আছে। ফলে নতুন নিয়োগের ফলে সেখানে জট কমার ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ তৈরি হলো।
জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন
বিচারকদের কর্মকাল বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, আপিল বিভাগে নতুন তিন বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারকরা বাদ পড়েছেন।
হাইকোর্ট বিভাগের ৮৭ জন বিচারকের মধ্যে বিচারপতি আবদুল হাফিজের চেয়ে জ্যেষ্ঠ ছিলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী।
বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক সালমা মাসুদের বাবা চৌধুরী এ টি এম মাসুদ আপিল বিভাগের বিচারক ছিলেন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের সময় সিইসির দায়িত্বেও ছিলেন।
বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন তাদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ ৪০ জন বিচারককে ডিঙিয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন।
হাইকোর্ট বিভাগে জ্যেষ্ঠতার ক্রমে সালমা মাসুদ ও আবদুল হাফিজের পরের স্থানগুলোতে রয়েছেন- বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ (ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের ছেলে), বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী (বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান চৌধুরীর ছেলে), বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান, বিচারপতি মো. জিয়াউল করিম, বিচারপতি রেজাউল হক, বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি মামনুন রহমান (আইনজীবী রেজাউর রহমানের ছেলে), বিচারপতি ফারাহ মাহবুব (সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমানের মেয়ে), বিচারপতি নাইমা হায়দার (সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে)।
হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় নিয়োগ দিতে হবে, এমন কোনও আইন নেই। তবে সাধারণত জ্যেষ্ঠদের প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।
সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানকে দেওয়া আছে। সেখানে বলা আছে, “রাষ্ট্রপতি যেরূপ সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল ওই বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন।”
সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগের শর্তে বলা আছে, সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন ১০ বছর ওকালতির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা বিচারক হিসাবে ১০ বছর আদালতে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর।
এর আগে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ৩০ জনকে ডিঙিয়ে তিন বিচারককে নিয়োগ দেওয়ায় জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছিল তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জ্যেষ্ঠদের নিয়োগ দেওয়ার প্রথা এক সময় অনুসরণ করা হলেও এখন তা আর হচ্ছে না।
“এখন আর এগুলা কেউ মানে না। এই সরকারের আমলে কোনও কিছুই মানে না। সরকার ইচ্ছামতো নিয়োগ দিতে পারে।”
সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সংবিধানে আছে বিচারপতি নিয়োগের আইন করতে হবে। কিন্তু কোনও সরকারই এখন পর্যন্ত আইনটি করেনি। সেজন্য ইচ্ছামতো বিচারপতি নিয়োগ হয়, আপিল বিভাগে নেয়।”
নতুন যারা
বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি এবং এলএমএম ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮২ সালে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।
তিনি ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর পর তার নিয়োগ স্থায়ী হয়। ১৯ বছর ধরে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ চালিয়ে আসছেন। আগামী ৩১ মে অবসরে যাবেন তিনি। ফলে আপিল বিভাগে তিনি দেড় মাসও দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮৩ সালে মুন্সেফ হিসাবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ২০০১ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে জেলা ও দায়রা জজ হন।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে ২০১০ সালে তিনি ওই ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান। পরে ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালের বিচারকের দায়িত্ব পান তিনি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
শাহীনুর ইসলাম ২০১৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর পর তার নিয়োগ স্থায়ী হয়। বয়স অনুসারে ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল তিনি অবসরে যাবেন। ফলে এক বছরের বেশি সময় তিনি আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছেন।
বিচারপতি কাশেফা হোসেন প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। পরে এলএলবি করে তিনি ১৯৯৫ সালে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
২০১৩ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান কাশেফা হোসেন। এর দুই বছর পর তিনি স্থায়ী হন। বয়স অনুযায়ী ২০২৫ সালের ৩০ জুন তার অবসরে যাওয়ার কথা। ফলে তিনিও এক বছরের বেশি সময় সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন।