তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন হচ্ছে। এজন্য আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
রবিবার ঢাকার মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছেন রিভিউকারীদের পক্ষের আইনজীবী শরীফ ভূইয়া।
প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে এ আইনজীবী বলেন, “আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত থেকে অনুমতি নিয়েছি। আগামী মঙ্গলবার আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি দায়ের করা হবে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, সেটি ‘ভুল’ ছিল দাবি করে তিনি বলেন, “যে রায়ের কারণে পুরো দেশকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আমরা আশা করি, আপিল বিভাগ রায়টি পুনর্বিবেচনা করবেন এবং এই ভুল সংশোধন করবেন।”
রিভিউ আবেদনকারীরা হলেন- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ, তরুণ ভোটার মো. জুবায়রুল হক নাহিদসহ পাঁচজন।
আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, “যেহেতু রিভিউ আবেদনকারীরা (এই মামলায়) পক্ষভুক্ত ছিলেন না। তারা পক্ষভুক্ত হতে চাইলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। যে কারণে আদালত থেকে আমরা অনুমতি নিয়েছি।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংবিধানে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনের পরপরই এই রিভিউয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
যে যুক্তিতে রিভিউ
রিভিউর ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের যুক্তি, “মৌলিক কাঠামোর মধ্যে একটা হলো গণতন্ত্র, আরেকটি হলো নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন। একটি আরেকটির পরিপূরক। এই সংশোধনীর মাধ্যমে এটি খর্ব করা হয়েছে। তার কারণ হলো তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
“যেহেতু সংবিধানে আছে জনগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এখন এই জনগণ যদি তাদের ভোট দিতে না পারে, তাহলে তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। কাজেই এটা সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ, এটা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া যায় না।”
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তার বিপরীতে আবেদনকারীরা বলছেন, এটা ঠিক নয়। বরং ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ।
এছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশে আরও দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে সেটি রাখা হয়নি, যা সাংঘর্ষিক রায়।
“একটি রায়ের ১৬ মাস পর কীভাবে সেটি বদলিয়ে ফেলা হয়। যে কারণে এটা রিভিউ করা উচিৎ। আজকে দেশের এ অবস্থার জন্য দায়ী এই সংশোধনী,” বলেন আইনজীবী শরীফ।
কী ছিল রায়
২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে করা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেদিন সংক্ষিপ্ত রায়ে পরবর্তী দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল আদালত।
রায়ে বলা হয়, এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে সংসদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
রায়ে বলা হয়, আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই আবেদনটি গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ এই নির্দেশের পর থেকে অবৈধ ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করা হলো। তবে আইনসম্মত না হলেও (প্রয়োজনের কারণে আইনসম্মত এবং জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—সুপ্রাচীনকাল ধরে চলে আসা নীতিমালার ভিত্তিতে) আগামী দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায়ই হতে পারে।
এসময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে অথবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিধানটি বাতিল করার পূর্ণ স্বাধীনতাও সংসদের থাকবে, বলা হয়েছিল রায়ে।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৯৬ সালে। এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন আদালতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দেয়। তাতে বলা হয়, “ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনও মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।”
সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে গিয়েছিল। এর মধ্যে সলিম উল্লাহ মারা যাওয়ায় পর আব্দুল মান্নান খান নামের আরেকজন আইনজীবী সেই আবেদনটিকে এগিয়ে নেন।
দীর্ঘদিন পর ২০১১ সালে মার্চ মাসে আপিল বিভাগে সেই আপিলের শুনানি শুরু হয়। মামলায় আটজন আমিচি কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনে আপিল বিভাগ।
এদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এরা হলেন- ড. কামাল হোসেন, টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ।
আমিকাস কিউরিয়া ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন।
রায় দিতে গিয়ে সাত বিচারকের আপিল বিভাগ একমত হতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়েছিল সেই রায়। চারজন বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, দুজন ছিলেন বহাল রাখার পক্ষে। বাকি একজন বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর অবসরে গিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন।
তাতে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
বিচারপতি এস কে সিনহাও আলাদাভাবে অভিমত লেখেন। তিনি দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তবে এই সরকারে বিচারপতিদের বাদ দিতে বলেন।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। শুধু বিচারপতি ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে মত দেন।
তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়টি আর ছিল না।
২০১১ সালে ওই রায় হওয়ার পরের মাসে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংেশাধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে। যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদ সৃষ্টি করে। ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোর দুটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। একটিতে সব দল অংশ নিলেও তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য দুটির মতোই প্রশ্নবিদ্ধ।
এভাবে দেড় দশক ধরে থাকা আওয়ামী লীগের সরকার গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হলে সংবিধানের বাইরে গিয়েই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।