ট্রাম্প শুল্কের ধাক্কাসহ নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটিতে প্রায় ৩০০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। চার মাসের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও নেই এই বাজারে শীর্ষ দশ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ৬৬ শতাংশ। ভিয়েতনামের বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
এদিকে অনেক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনকে টপকে শীর্ষস্থান দখল করেছে ভিয়েতনাম। ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে চীনের চেয়ে ৭৩ কোটি ১৫ লাখ ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমনটাই উঠে এসেছে। সোমবার এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ৬২১ কোটি ৮০ লাখ (২৬.২২ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মোট রপ্তানি আয়ের ১৭ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ এসেছিল এই বাজার থেকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো ২৫ শতাংশ কমেছিল।
সেই নেতিবাচক ধারা চলে ২০২৪ সালেও। তবে বছরের শেষ দিকে এসে গতি বাড়ায় শেষ পর্যন্ত নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল বছর। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যা ছিল ২০২৩ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
২০২৫ সাল শুরু হয়েছে বড় চমক দিয়ে; চার মাসে ২৯ শতাংশের প্রবৃদ্ধি অবশ্যই ভালো খবর। তা দেখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা বেজায় খুশি হয়ে ব্যবসা যখন আরও বাড়ার আশা করছিলেন; হিসাব কষে দেখছিলেন, এবছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি ২৫ শতাংশ বাড়বে।
ঠিক তখনই আঘাত হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতি। গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। তাতে বাংলাদেশের পণ্যে যোগ হয় ৩৭ শতাংশ শুল্ক। আগের ১৫ শতাংশের সঙ্গে মিলে সর্বমোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫২ শতাংশ।
৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক কার্যকরের দিন অনেকটা ‘ইউটার্ন’ করে তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক থাকলেও চীনা পণ্যে মার্কিন শুল্কের হার ১৪৫ শতাংশ। বেইজিং দফায় দফায় পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫ শতাংশে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
চীনের কিছু অর্ডার বাংলাদেশে আসছে
অটেক্সা সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা এপ্রিল পর্যন্ত। এপ্রিল থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে। ট্রাম্প তিন মাসের জন্য যে পাল্টা শুল্ক স্থগিত করেছিলেন, তার শেষ হয়ে গেছে।
‘ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর থাকায় আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে’ জানিয়ে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১০ শতাংশ ট্রাম্প শুল্কের ধাক্কা আমাদের ওপর পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি যেটা বাড়ছে, সেটা আসলে চীনের কিছু অর্ডার আমাদের এখানে চলে আসার কারণে।”
তিনি বলেন, “নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছি আমরা। চলতি অর্থ বছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ১২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এখন কী হবে সেটা নিয়েই আতঙ্কিত আমরা।”
হাতেম বলেন, “জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি ছিলাম। তবে আমাদের সামগ্রিক অর্ডার কিন্তু কমছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ চলছে; বিশ্ব পরিস্থিতি উত্তপ্ত। জানি না আগামী মাসগুলোতে কী হবে।
“বিশ্বজুড়ে রীতিমতো বাণিজ্য যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ঝড় তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটার পরিণতি কী হবে, তা আমরা পরিষ্কার কিছুই বুঝতে পারছি না।”
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, “কয়েক দিন আগে আগে চট্টগ্রামের এক পোশাক ব্যবসায়ী আমাকে বললেন, ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কের কারণে তাকে ২ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। এর মানে ট্রাম্প শুল্পের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে বেশ ভালোভাবেই পড়বে।”
শীর্ষে ভিয়েতনাম, তৃতীয় বাংলাদেশ
অনেক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনকে টপকে শীর্ষস্থান দখলে করেছে ভিয়েতনাম। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে চীনের চেয়ে ৭৩ কোটি ১৫ লাখ ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম।
জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫০৮ কোটি ৯১ লাখ (৫.০৯ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।
এই চার মাসে চীন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৪৩৫ কোটি ৭৬ লাখ (৪.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক। প্রবৃদ্ধি দশমিক ৬৬ শতাংশ।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছর এই বাজারে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। তার মানে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২৯৮ কোটি ৩১ লাখ (প্রায় ৩ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক। প্রতি মাসে গড় রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ৭৪ দশমিক ৫৮ কোটি ডলার।
চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের রপ্তানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আর পঞ্চম শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি করেছে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন)) ডলারে পণ্য। তাদের রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম চার মাসে মেক্সিকো ৮৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, হন্ডুরাস ৬৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, কম্বোডিয়া ১২৩ কোটি, পাকিস্তান ৭৫ কোটি ও কোরিয়া ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে কম্বোডিয়ার সবচেয়ে বেশি ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
পাকিস্তানের রপ্তানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মেক্সিকো ও কোরিয়ার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫৬ শতাংশ করে। যদিও হন্ডুরাসের রপ্তানি কমে গেছে ১০ শতাংশ।