Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

২৭ বছর পর কারামুক্ত, কে এই সুইডেন আসলাম

সুইডেন আসলামের এই একটি ছবিই পাওয়া যায় ইন্টারনেটে।
সুইডেন আসলামের এই একটি ছবিই পাওয়া যায় ইন্টারনেটে।
Picture of সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

নাম তার শেখ মো. আসলাম, কিন্তু পরিচিতি সুইডেন আসলাম নামে; শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে পুলিশের খাতায় নামটি ছিল ওপরের দিকে; গ্রেপ্তার হয়ে ২৭ বছর কারাভোগের পর হলেন মুক্ত।

দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক রাজনীতিকের মুক্তির সঙ্গে বুধবার গাজীপুরের কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে সুইডেন আসলামের ছাড়া পাওয়ার খবরটিও এসেছে।

এই কারাগারের জেলার লুৎফর রহমানকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার রাত ৯টায় কারামুক্ত হন সুইডেন আসলাম। কারাফটকে অপেক্ষারত স্বজনদের সঙ্গে তিনি চলে যান।

অন্য সব মামলা নিষ্পত্তি হলেও যুবলীগের এক নেতা হত্যার মামলায় আটকে ছিলেন সুইডেন আসলাম। সেই মামলায় আদালত থেকে জামিন হওয়ার পর মুক্ত হলেন তিনি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ সুইডেন আসলাম ছিল ব্যাপক উচ্চারিত একটি নাম। বেশ কয়েকটি খুনের আসামি ছিলেন তিনি।

যুবলীগের এক নেতাকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয় সুইডেন আসলামকে।

গ্রেপ্তারের সময় সুইডেন আসলাম ছিলেন ৩৫ বছরের যুবক; দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে ৬২ বছর বয়সে বেরিয়ে এলেন তিনি।

উত্থানপর্ব

সুইডেন আসলামের পরিবারের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার আলগা ইউনিয়নের সাঁথিয়া গ্রামে। তবে তার বাবা শেখ জিন্নাত আলী পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকার নগরীর ইন্দিরা রোডে। ফার্মগেইটে রড-সিমেন্টের দোকান ছিল জিন্নাত আলীর। তার তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ফার্মগেইটে উঠতি রংবাজ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক, বর্তমানে দৈনিক আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান তার সংবাদপত্রে ২০২২ সালে লিখেছিলেন সুইডেন আসলামকে নিয়ে।

সেখানে বলা হয়েছিল, এইচ এম এরশাদের শাসনামলে আসলামের উত্থান পর্বের সূচনা হয়েছিল আজাদ ও বাপ্পী নামে দুই সহোদরকে পেটানোর মাধ্যমে। তখন ওই দুই ভাই ফার্মগেইট এলাকার অপরাধকর্মসহ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

একদিন ফার্মগেইটের নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পীকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম। এরপর পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখেন। তখন থেকে উত্থান হয় আসলামের।

শাকিল নামের এক কিশোরকে হত্যার মধ্য দিয়ে আসলামের হত্যাকাণ্ডের শুরু বলে কামরুল হাসান লিখেছেন। ১৯৮৭ সালে পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুলের ভেতরে মায়ের সামনে খুন করা হয়েছিল শাকিলকে।

সেই হত্যাকাণ্ডে আসলামের সহযোগী হিসাবে যাদের নাম আসে, তারা হলেন পূর্ব রাজাবাজারের সুমন, ব্যাটারি বাবু, মণিপুরিপাড়ার বিআরটিসি কোয়ার্টারের আমজাদ হোসেন, পূর্ব রাজাবাজারের বাবু এবং কলাবাগানের সাবু।

নাম কেন সুইডেন আসলাম

আসলামের নাম কীভাবে সুইডেন আসলাম হয়ে উঠল, সেই বর্ণনাও দিয়েছেন সাংবাদিক কামরুল হাসান।

তার লেখা অনুযায়ী, ফার্মগেইট এলাকায় তখন ‘চাইনিজ’ নামের আরেক সন্ত্রাসী ছিলেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে তার সুইডেন প্রবাসী বোন ইতিকে বিয়ে করেন আসলাম। শাকিলকে খুনের পর আসলাম সুইডেনে স্ত্রীর কাছে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সেখানে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে আসলামের। দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর আসলাম দেশে ফিরে তার সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। সুইডেন থেকে আসার কারণে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ তার নাম হয়ে যায় সুইডেন আসলাম।

এদিকে আসলামের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর ইতি ঢাকায় এসে মামুন নামের এক সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেন। তখন তাকে খুন করার পরিকল্পনা করেন সুইডেন আসলাম।

১৯৯৫ সালের মে মাসে পুরান ঢাকার সন্ত্রাসী আগা শামীমের আস্তানায় সমঝোতার কথা বলে মামুনকে ডেকে এনে হত্যা করা হয়। মামুনসহ তিনজন খুন হন সেখানে।

২০০৪ সালের জুন মাসে এই হত্যাকাণ্ডের রায়ে আগা শামীমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সুইডেন আসলাম খালাস পান।

শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে দাপট

সাবেক স্ত্রীর স্বামীকে খুনের পাশাপাশি এই ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডও সুইডেন আসলাম ঘটিয়েছিলেন, যা উঠে আসে কামরুল হাসানের লেখায়।

তার বিবরণে, তখন মামুন ও ইতির বিয়েতে সহায়তা করেছিলেন আসলামের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ বিপুল। একদিন মধুবাগের মাঠে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত কেটে তাকে খুন করান আসলাম। বিপুলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কলাবাগানের কিসলুকেও মেরে ফেলা হয়।

আসলামের আরেক সহযোগী ছিলেন গাব্বু। তার স্ত্রী আসমা একবার পুলিশকে আসলামের গতিবিধির কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন তেজগাঁও রেললাইনের বস্তিতে গাব্বুর সামনেই আসমাকে বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ওই সময়কালে মিরপুরে রানা, সাজ্জাদ, টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা শামীম তালুকদারও সুইডেন আসলামের হাতে খুন হয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

নিজের ‘সাম্রাজ্য’ ঠিক রাখতে কারওয়ান বাজারের পিচ্চি হান্নান, মগবাজারের সুব্রত বাইন ও টিক্কার সঙ্গে এক হয়েছিলেন আসলাম।

তখন শোনা যেত, বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয় পাচ্ছিলেন আসলাম। তবে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর সুইডেন আসলামের নাম শীর্ষসন্ত্রাসীর তালিকায় তুলে তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল।

গ্রেপ্তার সুইডেন আসলাম গত ১০ বছর ধরে ছিলেন কাশিমপুর কারাগারে।

গ্রেপ্তার হন যেভাবে

তেজগাঁওয়ের যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক খান গালিব হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সুইডেন আসলাম। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ তেজকুনিপাড়ার বাসার সামনে খুন হন গালিব। গালিবের স্ত্রী শাহেদা নাসরিন শম্পা তখন তেজগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পর ১৯৯৭ সালে ২৬ মে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সুইডেন আসলামকে।

সেদিনের বর্ণনা দিয়ে কামরুল হাসান লিখেছেন, “বিকেলে আমরা বসে আছি মিন্টো রোডে ডিবি অফিসে জনসংযোগ শাখার সহকারী কমিশনার মিয়া আব্দুস ছালামের রুমে। হঠাৎ ওয়াকিটকিতে ব্যাপক শোরগোল। বড় এক আসামি ধরা পড়েছে। ঘণ্টাখানেক পর সেই আসামিকে আনা হয় কড়া পাহারায়।

“আমরা দৌড়ে গেলাম আকরাম হোসেনের (তখন সহকারী পুলিশ কমিশনার) রুমে। দেখি হ্যান্ডকাফ পরা তরুণকে আরও শক্ত করে বাঁধা হচ্ছে। সেই তরুণকে আমরা সহজেই চিনে ফেললাম, তিনিই হলেন সুইডেন আসলাম।”

তখনকার ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা আকরাম এই গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল খুনের ঘটনায় এই পুলিশ কর্মকর্তার কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি কয়েকবছর আগে মারা যান।

সেদিন এসি আকরামের অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তার সুইডেন আসলামের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন কামরুল হাসান।

তিনি লিখছেন, “কিন্তু আসলাম কোনও কথা বললেন না। যা জিজ্ঞাসা করি, মাথা নিচু করে থাকেন। তাকে দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হলেও মুখ খোলেন না।”

সেই যে কারাবাস শুরু হলো সুইডেন আসলামের, তার অবসান ঘটল ২০২৪ সালে এসে।

ইতি থেকে সিমি

সুইডেন আসলাম গ্রেপ্তারের পর তার সাবেক স্ত্রী ইতির সঙ্গে কথা হয়েছিল কামরুল হাসানের, তিনি তখন জনকণ্ঠে কাজ করেন।

কামরুল লিখেছেন, “ইতি আমাকে বলেছিলেন, তিনি সুইডেন আসলামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে আসলাম মনে করতেন, হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিলেই তাকে মরতে হবে।”

ইতি পরে সুইডেনে ফিরে যান। সেখানে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে জীবনাবসান ঘটান তিনি।

ইতির সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সুইডেন আসলাম তার চাচা শেখ মো. আবদুল লতিফের মেয়ে সিমিকে বিয়ে করেন। ইন্দিরা রোডেই তাদের বাসা।

বিভিন্ন সময় সুইডেন আসলামকে নিয়ে তার স্ত্রীর বক্তব্য জানতে সাংবাদিকরা গেলেও বিফল হয়ে ফিরেছেন। তবে তিনি মনেই করছিলেন, স্বামীকে আর মুক্ত অবস্থায় দেখতে পারবেন না।

কারাগার থেকেই নিয়ন্ত্রণ

১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার হলেও সুইডেন আসলাম কারাগারে বসেই তার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিয়ম না থাকলেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এই কাজ করতেন তিনি। কারাগারে তার সেল থেকে দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধারে খবর এক সময় এসেছিল।

তার বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছিল, তাদের এবং সেই সব মামলার সাক্ষীদেরও হুমকি দিতেন সুইডেন আসলাম। সেই হুমকি পেয়ে অনেক বাদী ও সাক্ষী আদালতে যেতেন না বলে বেশিরভাগ মামলা থেকে তিনি খালাস পান।

এখন কীভাবে মুক্ত

সাংবাদিক কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে ২২টি মামলার তথ্য পেয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে। তার মধ্যে নয়টি হত্যা মামলা, বাকিগুলো অপহরণ-চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের মামলা।

অস্ত্র আইনের দুটি মামলায় তার যাবজ্জীবন এবং ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে এসব মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতি পান।

যে মামলায় সুইডেন আসলাম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেই গালিব হত্যা মামলার এক আসামি আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সুইডেন আসলামের উপস্থিতিতে দেলু ও মাসুদ গুলি করে খুন করেন গালিবকে।

এই মামলায় আসলামসহ ২০ জন আসামি। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর বিচার শুরু হলেও ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এপর্যন্ত ১৪ জনকে আদালতে আনা গেছে। আসলামের ভয়ে এই মামলার সাক্ষীরাও আদালতে যান না।

এই একটি মামলায় আসলাম আটকে ছিলেন। এর আগে শোনা গিয়েছিল, কারাগারের বাইরে বের হলে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় বাকি একটি মামলায় জামিনের আবেদন করছেন না সুইডেন আসলাম।

সরকার পরিবর্তনের পর সেই মামলাটিতে জামিন নিয়েই তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হলেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত