মাথায় সাহেবি টুপি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। গায়ে বাংলাদেশের জার্সি। চলমান ম্যাক্স গ্রুপ ৩৩তম জাতীয় সাঁতারে মিরপুরের সুইমিং পুলের এ পাড় থেকে ও পাড়ে একজন জাপানি ভদ্রলোক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনও সাঁতারুকে পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ এসে নিজের ভুলত্রুটি জানতে চাইছেন। অথচ তিনি ফেডারেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কোচ নন। স্বেচ্ছায় জাপান থেকে এসেছেন গত ৬ নভেম্বর। বাংলাদেশের সাঁতারের টানে বারবার এভাবেই ছুটে আসেন তাকাহিরো তাগুচি। কেনই বা বাংলাদেশের প্রতি তার এত ভালোবাসা, কি অবস্থায় আছেন এ দেশের সাঁতারুরা, সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো সব। এমনকি বাংলাতেই দিলেন সব প্রশ্নের উত্তর।
সকাল সন্ধ্যা : কেমন আছেন কোচ?
তাকাহিরো তাগুচি : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
সকাল সন্ধ্যা : বাংলাদেশে ঘরোয়া সাঁতার শুরু হলেই জাপান থেকে ছুটে আসেন? কেন?
তাকাহিরো : এটা তো অনেক কঠিন প্রশ্ন। এটা বলতে গেলে আপনার সঙ্গে সারা রাত কথা বলতে হবে। আমি তো জাপানি। কিন্তু বাংলাদেশকে আমার দ্বিতীয় বাড়ি মনে করি। সুইমিং ফেডারেশনে আমার অনেক ছাত্র ছাত্রী আছে। এজন্য এখানে আসতে আমার খুব ভালো লাগে।
সকাল সন্ধ্যা : এসএ গেমসে, অলিম্পিক, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা এশিয়ান গেমস- যেখানেই বাংলাদেশের সাঁতার সেখানেই আপনাকে বাংলাদেশের পতাকা জড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। কেন বাংলাদেশকে এত সমর্থন করেন?
তাকাহিরো : আমি প্রথমবার বাংলাদেশে আসি ১৯৮৭ সালে। সেটা প্রায় ৩৭ বছর আগের কথা। তখন থেকে আপনাদের সঙ্গেই আছি। অনেকে এটা ভালোভাবে নিয়েছে। অনেকে খারাপ কথা বলেছে। কিন্তু আমার হৃদয়ে শুধুই বাংলাদেশ। আমি নিজেকে বাঙালি মনে করি। বাংলাদেশকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার লক্ষ্যই হলো বাংলাদেশের সাঁতারের উন্নতি। এই কারণেই বারবার এখানে আসি। অন্য কোনও কারণ নেই।
সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের সাঁতার একটা জায়গা থেমে আছে? কেন?
তাকাহিরো : নতুন প্রজন্ম, নতুন ব্যাচ উঠে আসছে না সাঁতারে। ৪-৫ বছর আগে থেকে যে ট্যালেন্ট হান্টিং (সেরা সাঁতারুর খোঁজে) হয়েছিল সেই প্রতিযোগিতা এখন নেই। কিন্তু এটা প্রতি বছরে আয়োজন করতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক। যতো পুকুর, নদী, গ্রাম আছে সেখান থেকে ভালো ভালো সাঁতারুদের নিয়ে অনুশীলন করতে হবে। তারপর সেখান থেকে বাছাই করে ভালো সাঁতারু তৈরি করতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: অন্যরা তো ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে।
তাকাহিরো : ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তানের কথা ধরুন। তারা নিজেরা ক্যাম্প করছে বা দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। অথবা তারা দেশের বাইরে থেকে কোচ এনে সাঁতারুদের অনেক সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দিচেছ। সাঁতারু তৈরি করতে টাকা পয়সা অনেক লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিসেই নেই সাঁতারুরা। নতুন ব্যাচও আসেনি। এই জন্য বর্তমানে জাতীয় দল সব একই রকম। দেশের বাইরে যখন যায় কোনও পদক জেতে না।
সকাল সন্ধ্যা : আপনি তো বিকেএসপিরও কোচ ছিলেন। ওই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
তাকাহিরো : আসলে বিকেএসপি তো অনেক পুরনো প্রতিষ্ঠান। এরশাদ সাহেব (সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ) তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের মধ্যে খেলাধুলার এত ভালো সুযোগ সুবিধা আর কোথাও নেই। এই জন্য সাঁতার ফেডারেশন বা অন্যান্য ফেডারেশন খেলাধুলার জন্য সব সময় ওখানে ক্যাম্প করে। এটা কাজে লাগিয়ে জাতীয় দলের জন্য সাঁতারু তৈরি করতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা : সাঁতারের কোরিয়ান কোচ পার্ক তে গুন চলে যাওয়ার পর এসএ গেমসে সোনা জিততে পারছে না বাংলাদেশ। আপনার কি মনে হয় না বিদেশি কোচ প্রয়োজন?
তাকাহিরো : আমি একজন জাপানি। সুযোগ পেলে কাজ করব। কিন্তু বাংলাদেশে বেশি বেশি কোচ তৈরি করা দরকার। আমরা তো বিদেশি। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আমাদের মতো যারা ভালো কোচ আছে তাদের আরও অনেক সুবিধা দিতে হবে। সাঁতার ফেডারেশন আমাকে অনুরোধ করেছে জাপানে এদের নিয়ে গিয়ে কোচিং কোর্স করতে পারবো কিনা। কদিন আগে সাগর (মাহফুজুর রহমান) ও অনিককে (অনিক ইসলাম) নিয়ে গেলাম জাপানে। ওরা ১ মাস ছিল জাপানে। কিন্তু মাত্র ১ মাস ট্রেনিং যথেষ্ট না। সেখানে ভালো ভালো কোচের অধীনে ওরা ট্রেনিং নিয়েছে। জাপান থেকে ওরা যে অভিজ্ঞতা পেয়েছে সেটা বাংলাদেশে যাতে সেটা কাজে লাগাতে পেরে সেই সুযোগ ওদের দিতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: ২০১৬ সালের পর সাফের সাঁতারে সোনা জেতেনা বাংলাদেশ। আবারও কি সোনা জেতার কোনও সম্ভাবনা আছে?
তাকাহিরো : এটা অনেক কঠিন প্রশ্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখন ভারত, শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই বাংলাদেশের সাঁতারুরা পারবে না। সোনা জেতার সম্ভাবনা তাই খুবই কম। এটা তো মনে হয় সবাই জানে। অন্যরা অনেক এগিয়ে গেছে। এরপর পাকিস্তান আছে। নেপালও ভালো করছে। নেপালে তো সাংঘাতিক রকমের উন্নতি হচ্ছে।
সকাল সন্ধ্যা: একটু বিস্তারিত বলবেন।
তাকাহিরো: ছোট থেকে নেপাল সাঁতারু তৈরি করে। ট্রেনিং করে দেশের বাইরে। অনেকে এখন থাইল্যান্ডে ক্যাম্প করছে। নেপালের সাঁতার ফেডারেশন ও নেপাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন টাকা পয়সা দিচ্ছে ওদের। অথচ বাংলাদেশে শুধু একজন থাইল্যান্ডে আছে (সামিউল ইসলাম রাফি)। অন্যরা যেতে পারছে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কিভাবে সোনা জিতবে বাংলাদেশ? আমিও আপনার মতো ফেডারেশনকে প্রশ্ন করতে চাই, বাংলাদেশের সাঁতারের উদ্দেশ্য কি? কোন পথে হাঁটছে সাঁতার? ভবিষ্যতে তারা কি করতে চায়? আমিও জানতে চাই সেটা।
সকাল সন্ধ্যা: এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
তাকাহিরো : আমার পরিবারে স্ত্রী ও এক ছেলে আছে।
সকাল সন্ধ্যা: আপনার ছেলে কি করে?
তাকাহিরো: খুবই ভালো প্রশ্ন। আমার ছেলে বর্তমানে বিকেএসপিতে ফুটবল কোচ হিসেবে আছে। জাইকার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই কোচকে পেয়েছে।
সকাল সন্ধ্যা: অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে আছেন। বাংলাদেশের কোন খাবার বেশি ভালো লাগে?
তাকাহিরো : আমার প্রিয় খাবার টাকি মাছের ভর্তা। আসলে বাংলাদেশের যে কোনও ভর্তা আমি বেশি পছন্দ করি। বলতে পারেন নিরামিষ খাবার পছন্দ। এরপর ঝোল তরকারি, মুগ ডাল, দেশি মুরগি, মোরগ পোলাও পছন্দ।
সকাল সন্ধ্যা: আর জাপানি সুশি..
তাকাহিরো: এখানে গুলশান ও বনানীতে পাওয়া যায় সুশি। কিন্তু ওখানকার খাবার অতটা ভালো লাগে না। সুস্বাদু লাগে না। কিন্তু এখানে যে কোনও বাঙালির বাসায় দাওয়াত খেতে যখন যাই তখন ওই বাসার মা-বউয়ের হাতের যে রান্না বাঙালি খাবার ওটার স্বাদ মজার।
সকাল সন্ধ্যা : মনে হচ্ছে বাংলা ভাষাটা সহজেই রপ্ত করেছেন। কিভাবে?
তাকাহিরো: আপনি বললেন সহজ ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষা অত সহজ না। আল্লাহ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। ৩৭ বছর আগে যখন প্রথম আসি তখন বাংলা বলতাম শিশুদের মত। এখন যারা কর্মকর্তা হয়ে গেছে সেলিম, মনিরুজ্জামান, শামসুল ওরা আমাকে বাংলা শিখিয়েছে।
সকাল সন্ধ্যা: বাংলা ভাষার কোন কথাটা বলতে বেশি ভালো লাগে?
তাকাহিরো: বাংলা গান ভালো লাগে। আমি সেতার বাজাতে পারে। সেতারে বাংলা গানের সুর তুলি। আমি গাইতে পারি না। তবু গাইছি- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
সকাল সন্ধ্যা: কোচ আপনাকে ধন্যবাদ।
তাকাহিরো : আপনাকেও ধন্যবাদ