সিলেটে নেমে যাচ্ছে বন্যার পানি, কমে আসছে বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা, সেই সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে বন্যার রেখে যাওয়া ক্ষত। স্থানীয় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বলছে, দুই দফার বন্যায় সিলেটে বিভিন্ন খাতে প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সিলেটের বেশ কিছু রাস্তাঘাট। তাই চলাফেরায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের। আবাসন খাতের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত। প্লাবিত হয়ে পড়ে মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ও শ্মশানঘাট। সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বন্যায় ১৩ উপজেলায় ১৫ হাজার ৫০৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
গত ২৯ মে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৮ জুনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়।
বন্যার দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ১৬ জুন। সেদিন আবার পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা বন্যার কবলে পড়ে। পরবর্তীতে নগর এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা দেখা যায়।
বন্যায় সিলেট নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৯টি ওয়ার্ড পানিতে ভেসে যায়। কয়েকটি ওয়ার্ডের পানি দুয়েকদিনের মধ্যে নেমে গেলেও ১৫টি পানিতে নিমজ্জিত থাকে প্রায় এক সপ্তাহ।
এতে রাস্তাঘাটের পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
এরপর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে পানি। সিলেট নগরে এখন বন্যাকবলিত ওয়ার্ড ২টি। ২টি ওয়ার্ডে বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০ জন। নগরের ২টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ২০০ জন।
বন্যাপ্লাবিত সিলেটের সিংহভাগ এলাকা থেকে এখন পানি নামলেও ধকল কাটিয়ে কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে, তা ভেবে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা।
সিলেটে দুই দফার বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা বাড়িঘর। এতে অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বাড়িঘরে পানি উঠে আসবাবপত্র এমনকি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন।
এবারের বন্যায় বেশ ভালোই ভুগেছে বিভাগের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ১৫ দিনের মধ্যে ৪ বার জলাবদ্ধতা দেখা দেয় প্রতিষ্ঠানটিতে। এসময় হাসপাতালের নিচতলার বিভিন্ন কক্ষ, সরঞ্জামের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চলাচলের পথগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া সিলেট ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয় প্রায় এক সপ্তাহ ছিল জলমগ্ন।
বন্যায় ভোগান্তি সম্পর্কে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বন্যায় হাসপাতাল ভবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরঞ্জাম, লিফট ও আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছে।
“আমরা মন্ত্রণালয়কে সব কিছু জানিয়েছি। তবে ঠিক কত টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।”
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী জানান, জেলার কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্যার পানি ওঠায় ভবন ও আসবাবপত্রের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
জেলার ৫১টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও কয়েকটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষয়ক্ষতির তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক তপন কান্তি ঘোষ জানান, সিলেট জেলার ২৬টি ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র শতভাগ নিমজ্জিত হয়। চারটি কেন্দ্রের সিংহভাগই প্লাবিত হয়। এতে ভবন ও আসবাবপত্রের অনেক ক্ষতি হয়।
নগরের ২৫০ কিলোমিটার রাস্তায় পানি উঠেছিল জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরির কাজ করছি। নগরের অনেক রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে। কোথাও কোথাও দেবে গেছে। বন্যার পানিতে ড্রেন, কালভার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
সিলেট জেলায় কৃষকের সংখ্যা ৯৮ হাজার ৬৫৩। দুই দফার বন্যায় তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে জানিয়েছেন সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যার পানিতে ১৫ হাজার ৫০৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এতে জেলার ৯৮ হাজার ৬৫৩ কৃষকের ২৭৫ কোটি ২১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়।”
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সিলেটে অনেক সড়ক এখনও পানিতে নিমজ্জিত। তাই ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিরূপন করা যায়নি জানিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন বলেন, “সিলেটের ১৩টি উপজেলার ১৬০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাথমিকভাবে বলা যায়, প্রায় ১১৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানি পুরোপুরি নামলে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিরূপণ করা হবে।”
এই প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপদ (সওজ) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন জানান, বন্যায় সড়ক বিভাগের ৪০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক হিসাবে তা প্রায় ৮৫ কোটি টাকার ক্ষতি। কয়েকটি সড়ক জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। সড়ক বিভাগের কোনও রাস্তায় এখন বন্যার পানি নেই।
বন্যায় মৎস্য সম্পদের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছেন জেলা মৎস্য কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক সীমা রাণী বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “বন্যায় জেলায় ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ২১ হাজার ১১১টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
“সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় ৬ হাজার ৭৫৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গিয়ে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশাদ বলেন, “৪১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করায় আসবাবপত্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনও অনেক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বন্যায় ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার আসবাবপত্রসহ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আবদুল ওয়াদুদ।
অন্যদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মিজানুর রহমান মিয়া বলেন, “বন্যায় অনেক হাঁস, মুরগী ভেসে গেছে। গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর প্রাণহানি হয়নি। আমরা আপাতত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া গবাদিপশুকে চিকিৎসা দিচ্ছি। পানি নেমে গেলে যাতে সংক্রামক রোগ দেখা না দেয়, এজন্য ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করা হবে।”
বন্যার ক্ষত পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতিটি সেক্টরে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে।”
সমন্বিতভাবে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে বলেও জানান তিনি। বলেন, “জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরিভিত্তিতে গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে।”
ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “আমরা নগর এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করব।
“এছাড়া ছড়া খনন ও উদ্ধার, নদী খনন ও সুরমা নদীর উভয় তীরে নগর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছি।”