অতি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেট অঞ্চলের কিছু জায়গা থেকে পানি নামলেও বন্যা কবলিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সবমিলিয়ে সিলেট বিভাগে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ২২ লাখ মানুষ।বন্যাদুর্গতদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র, পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ। তবে দুর্গম এলাকায় এখনও ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকে।
সিলেটের সুরমা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে কমলেও কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীর পানি কয়েকটি পয়েন্টে বেড়েছে। এতে সিলেট নগর ও সুনামগঞ্জ শহরের কিছু এলাকা থেকে পানি নেমেছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু এলাকা।
সিলেটে নদীর পানি কমছে
সিলেট নগরে মোট ৪২টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে উচু এলাকাগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। এখনও বন্যার পানির নিচে রয়েছে ২৩টি ওয়ার্ড। সিলেটে বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ওসমানীনগর উপজেলায় বেশি হলেও, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বেশি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যা বুধবার সন্ধ্যায় ছিল ৯৬ সেন্টিমিটার উপরে, সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যা বুধবার ছিল ৩৭ সেন্টিমিটার উপরে।
কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যা বুধবার ছিল ১০০ সেন্টিমিটার উপরে। এছাড়া জকিগঞ্জের অমলসিদে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০০ দশমিক ২ মিলিমিটার। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২০ মিলিমিটার।
দেশের ভেতরে ও উজানে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর পানি কমছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “উঁচু এলাকা থেকে পানি নিচু এলাকায় নামতে থাকায় ভাটি এলাকার উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।”
সিলেট নগরের মাছুদিঘিরপাড়, তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, শামীমাবাদ এলাকা থেকে পানি কিছুটা নেমেছে।
তবে কালীঘাট, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, চালিবন্দর, কাষ্টঘর, সোবহানীঘাট, যতরপুর, তেরোরতন, উপশহর, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, ইসলামপুর, তেমুখী, ঘাসিটুলা, বেতেরবাজার, তোপখানা, কাজিরবাজার, কামালগড় এলাকায় পানি রয়েছে হাঁটু সমান।
বৃহস্পতিবার সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেটের ৩৯ নং ওয়ার্ডে ত্রাণ বিতরণ করে বলেন, “পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও ২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ উঠেছেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ৭ হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। রাতেও খাবার পরিবেশন করা হবে।”
নগরের দুর্গত এলাকায় ৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানান সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
সিলেট জেলার ১৩ টি উপজেলার বেশিরভাগ ইউনিয়নই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত ওসমানীনগর উপজেলা। এই উপজেলায় বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজার।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, জেলায় ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হলেও ব্যবহৃত হচ্ছে ৩৬১টি।
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সিলেট নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১৩ উপজেলার ১০৩টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। বন্যায় আক্রান্ত জনসংখ্যা ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে সিলেট নগরের বাসিন্দা ৫৫ হাজার। জেলায় ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেট নগরে ৮০টিসহ জেলায় মোট ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বর্তমানে ২১ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন।
যদিও কিছু এলাকায় ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ এসেছে বন্যাদুর্গতদের কাছ থেকে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের দীঘলবাগের পাড়া ফেদারগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি জফির উদ্দিন জানান, দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা একেবারেই কম। তার বিদ্যালয়ে ৩০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা কোনও সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাননি।
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি কমতে থাকায় শহরের কিছু এলাকা থেকে পানি নেমেছে। তবে বিভিন্ন উপজেলায় বেড়েছে বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা। বৃহস্পতিবার সকালে সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া দিরাই উপজেলায় নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও আগের থেকে পানি কমেছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড, সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বৃষ্টি না হলে বন্যা পরিস্থিতি আর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা নাই।”
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জেলার ১২টি উপজেলার ১১টি প্লাবিত হয়ে পড়েছে। জেলার ৮০টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভায় বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লাখ ৪২ হাজার ৫৯৬ জন। জেলায় মোট ৬৯৪টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ২৩ হাজার ৮৪৯ জন।
সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাতক উপজেলা। এই উপজেলার ৩ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ১০ হাজার ৫১১ জন।
সুনামগঞ্জ শহরের কিছু এলাকা থেকে পানি নামলেও বড়পাড়া, তেঘরিয়া, আরপিন নগর, আফতাব নগর, নতুনপাড়া, শান্তিবাগ, হাছননগর ও হাজীপাড়া আবাসিক এলাকা এখনও পানি নিমজ্জিত। এছাড়া বুধবার রাত থেকে জেলার দিরাই, শাল্লা, শান্তিগঞ্জ, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলায় কিছু গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ সদর ও জগন্নাথপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। ছাতক-সিলেট, ছাতক-সুনামগঞ্জ, দোয়ারাজার-সুনামগঞ্জ সড়ক প্লাবিত হওয়ায় সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের অনেক জায়গা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অভ্যন্তরীন সড়কগুলো প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম সকাল সন্ধ্যাকে জানান, বুধবার জেলায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত ছিল, বৃহস্পতিবার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৩০৬টিতে। বন্যা দুর্গত প্রতিটি উপজেলায় মেডিকেল টিম কাজ করছে। বন্যা কবলিতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন।
মৌলভীবাজারের সাত উপজেলা প্লাবিত
মৌলভীবাজারে আরও বেড়েছে বন্যার পানি। জেলার সাত উপজেলার সবগুলোই এখন বন্যা কবলিত। জুড়ি, বড়লেখা, কুলাউড়া, রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নে ৪৭৪ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল সকাল সন্ধ্যাকে জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মনু নদীর পানি চাঁদনীঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং জুড়ি নদীর পানি বিপৎসীমার ২০৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি বন্যা কবলিত বড়লেখা উপজেলা। সেখানকার ২৫২টি গ্রামে ৯৩ হাজার ৫০০ জন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলায় ২২টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১৭০০ মানুষ।
টানা বৃষ্টিতে টিলা ধসে পড়ার আশঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবসাকারী পরিবারগুলোকে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়া বড়লেখা-কুলাউড়া সড়কের বেশ কয়েকটি স্থান পানি নিমজ্জিত হওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো.আব্দুস সালাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে জানান, জেলার ৪৭৪ টি গ্রামে ২ লাখ ৮১ হাজার ৯২০ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। জেলায় ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। ৫ উপজেলায় ৬ হাজার ২৫৩ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জেলায় ৭০ টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলেও জানান আব্দুস সালাম।
হবিগঞ্জে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে
হবিগঞ্জের সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও তা প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে। কুশিয়ারা নদীর বাঁধ উপচে নবীগঞ্জ উপজেলার ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হবিগঞ্জ সদর ও মাধবপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, হবিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে জানান, হবিগঞ্জে প্রায় সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কেবল কুশিয়ারা নদীর পানি নবীগঞ্জে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে প্লাবিত হয়েছে দীঘলবাক, কসবা, আহমদপুর, জামারগাঁও, দুর্গাপুর, দৌলতপুর, কুমার কাদা, পাহাড়পুরসহ কয়েকটি গ্রাম।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক প্রভাংশু সোম মহান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেলায় এখনও বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেনি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।”