চা পাতায় জমে থাকে ভোরের কুয়াশা। আঁকাবাঁকা পথ, ঘন সবুজ বনে হারিয়ে যায় মন। পাহাড়, নদী, ঝরনা, টিলা, সবুজ চা বাগান, দিগন্তজোড়া সবুজ বৃক্ষ, নীল আকাশের নিচে অপরূপ মায়াবী আভা রূপের রানীই করেছে সিলেটকে।
হযরত শাহজালাল (র.)-এর পুণ্যভূমি, মরমি কবি হাছন রাজা, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম, আলী আমজাদের ঘড়ি আর কিন ব্রিজের স্মৃতিবিজড়িত সিলেটের আরেকটা ইতিহাস আছে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে। ১৮৪৫ সালে উপমহাদেশের প্রথম রেকর্ডকৃত ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়েছিল সিলেটেই।
ইতিহাসের পাতায় সেই ম্যাচ
ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছে ২০০ বছর। তাদের মাধ্যমেই এই অঞ্চলে ছড়ায় খেলাটি। বিনোদনের জন্যই ইউরোপিয়ান অফিসারদের বিপক্ষে লাইট কোম্পানির সিপাহিদের একটি ম্যাচ সিলেটে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪৫ সালের ৩ মার্চ। আজ (রবিবার) প্রাচীনতম সেই ম্যাচের ১৮০ বছরে পদার্পণের দিন।
তখনকার ম্যাগাজিন ‘স্পোর্টিং ইনটেলিজেন্স’ ছাপিয়েছিল ম্যাচটির খবর । তাতে দাবি করা হয়েছে সিলেটের এই খেলাটা উপমহাদেশে প্রথম রেকর্ডকৃত কোন ক্রিকেট ম্যাচ। ম্যাগাজিনটির প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন ‘দ্য ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয় ১৮৩৩ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত। সেখানেই জানা যায় সিলেটের ম্যাচটা নিয়ে।
অনেকের ধারণা এটিই উপমহাদেশে রেকর্ডে থাকা প্রথম ম্যাচ। খেলাটি হয়েছিল তখনকার সিলেটের ২৮ নম্বর রেজিমেন্টে। আর ইউরোপিয়ানরা ক্রিকেটে পারদর্শী হওয়ায় জিতেছিল তারাই।
ভারতীয় ঐতিহাসিক রণজয় সেন তাঁর ‘নেশন অ্যাট প্লে: অ্যা হিস্ট্রি অব স্পোর্টস ইন ইন্ডিয়া’বইয়েও এই ম্যাচের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ৩ মার্চের বদলে ম্যাচের সময়ের কথা লিখেছেন একদিন এগিয়ে ২ মার্চ। তবে ‘স্পোর্টিং ইনটেলিজেন্স’-এ ম্যাচের তারিখ ৩ মার্চই লেখা হয়েছে।
দুলাল মাহমুদের স্বীকৃতি
টানা ২৮ বছর ‘ক্রীড়া জগত’-এর সম্পাদকের দায়িত্বে মাহমুদ হোসেন খান দুলাল। ক্রীড়াঙ্গনের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই সভাপতি। সিলেটের ১৮৪৫ সালের ৩ মার্চ হওয়া ম্যাচটা নিয়েও গবেষণা করেছেন তিনি ।
দুলাল মাহমুদের দাবি উপমহাদেশের প্রথম রেকর্ডকৃত ম্যাচ হয়েছে সিলেটেই, ‘‘ধরুন, প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু নিয়ে গবেষণার সময় বলা হল এটা এক হাজার বছর পুরোনো। কিছুদিন পর নতুন তথ্য পেলে বলা হয়, এক নয় এটা দুই হাজার বছর পুরোনো। ১৮৪৫ সালের ৩ মার্চ সিলেটের সেই ম্যাচ নিয়ে একই কথা বলব আমি। এ পর্যন্ত যত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে আছে, তাতে অবশ্যই সিলেটের খেলাটা উপমহাদেশে প্রথম রেকর্ডকৃত ম্যাচ।” রেকর্ডকৃত হওয়ায় স্কোরকার্ড ছিল এই ম্যাচের। তবে সেটা বেহাত হয়ে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও যে এসব ঐতিহাসিক নথির আর্কাইভাল ভ্যালু বোঝে না।
নথি নেই সিলেটে
১৮৪৫ সালের ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের কথা অজানা সিলেটের অনেকের কাছেই। ১৮০ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে কোথায় কি হয়েছিল, তা জানাও সম্ভব নয় সবসময়। তবে এ নিয়ে ধারণা আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক, সিলেট আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার সভাপতি ও সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানালেন, ‘‘ঐতিহাসিক ম্যাচটির কথা আমি জানি। সিলেটবাসীর জন্য গর্বের এটা। তবে এর তারিখ নিয়ে জানা ছিল না। আপনাকে ধন্যবাদ তারিখটা জানানোর জন্য। আমাদের সংগ্রহে এর কোনও নথি নেই। আমি যতদূর জানি, দিল্লীতে এই ম্যাচের একটা নথি সংরক্ষিত আছে।’’
তিনি আরও যোগ করলেন, ‘‘প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে আমরা এই ম্যাচের গল্প শুনেছি। ইংলিশম্যান পত্রিকার কয়েকটা কপি তিনি লন্ডন থেকে আনিয়েছিলেন। সেই কপিগুলো এখন আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই। তারিখটা যখন আপনার মাধ্যমে জানলাম, তখন আগামী বছর থেকে ম্যাচটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার আয়োজনের চেষ্টা করব আমি।”
আবুল মাল আবদুল মুহিতের কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিতও গর্ব নিয়ে বললেন ম্যাচটার কথা, ‘‘বাবা প্রায়ই গল্প করতেন এই ম্যাচ নিয়ে। কেউ সেভাবে পাত্তা দেয়নি। অনেকে ভেবেছিল তিনি ভুলভাল বলছেন। ইংলিশম্যান পত্রিকার কয়েকটা কপি তিনি আনিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমি সেগুলো দেখে অবাক হয়ে যাই, গর্বিতও হই। বিসিবি চাইলে আমি সেই ম্যাচের স্কোরকার্ড আর ইংলিশম্যান পত্রিকার আরও কিছু কপি লন্ডন থেকে সংগ্রহ করে দিতে পারি।’’
ইলেভেন গডস অ্যান্ড অ্যা বিলিয়ন ইন্ডিয়ানস-এ আছে বিস্তারিত
বিখ্যাত ভারতীয় ক্রীড়া সাংবাদিক, লেখক, ধারাভাষ্যকার ও গবেষক বোরিয়া মজুমদার। ২০১৮ সালে তার লেখা, ‘ইলেভেন গডস অ্যান্ড অ্যা বিলিয়ন ইন্ডিয়ানস’ -বইটি আলোড়ন ফেলেছিল যথেষ্ট।
বোরিয়া মজুমদার সেই বইয়ে ‘দ্য ইংলিশম্যান’পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন সিলেটের ম্যাচটি নিয়ে। উপমহাদেশে এটা প্রথম রেকর্ড করা ম্যাচ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন তিনি। তার বইয়ে সেই ম্যাচের উঠে এসেছে অনেক কিছু। সেই বইয়ে সিলেটকে লেখা হয়েছে ‘শ্রীহট্ট’ (সিলেটের আগের নাম)।
‘স্পোর্টিং ইনটেলিজেন্স’-এর প্রতিবেদকের উদ্ধৃতি, ‘‘তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিয়ে দেশীয় সিপাহিরা ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেক ভালো খেলা উপহার দেয়। আমি নিজে একজন ক্রিকেটার না হয়েও সবসময় সিপাহিদের খেলা দেখতে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকি। সিপাহিদের মধ্যে আমি দেখলাম এক বা একাধিক ব্যক্তি ভালো বোলিং করেছে, কেউ আবার খুব ভালো উইকেটকিপার। আর অন্যরাও ক্যাচ ধরছে বেশ সুন্দরভাবে…এবং ফিল্ডাররা, অতি সামান্য ইউরোপিয়ানরাই তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সিপাহি লুঙ্গমের কথা। অসামান্য ব্যাটিং করতেন তিনি। এও বলা হয়েছে, দুই এক বছরের মধ্যে স্থানীয় সিপাহিরা ভারতের সেরা ইউরোপীয় প্রতিভাবানদের সামাল দেবার ক্ষমতা অর্জন করবে।
‘স্পোর্টিং ইনটেলিজেন্স’-এর আরেকটি প্রতিবেদনে ‘সিপয় ক্রিকেট ইন সিলেট’-এ উঠে এসেছে দুটি রেজিমেন্টের মধ্যে ম্যাচের কথা। এর একটি দলে ছিল আটজন স্থানীয় ক্রিকেটার।
স্থানীয় সিপাহি ও রেজিমেন্টের ইউরোপয়ীরা যে ম্যাচেই মুখোমুখি হতেন, সেগুলো পেত বিশেষ মাত্রা। এই ম্যাচগুলোয় ফুটে উঠত আদি-জাতীয়তাবাদীর ছবি-যেমনটা দেখানো হয়েছে আমির খানের সিনেমা ‘লাগান’-এ। ইউরোপীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের শক্তি প্রদর্শনের দারুণ এক মঞ্চ হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট মাঠ।
সে সময় সিলেটের পাশাপাশি ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ব্যারাকপুর, দমদম, আগ্রা, কটক, মেদিনীপুরে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্রও ছিল এই শহরগুলো! তাই ১৮৪৫ সালের ৩ মার্চ সিলেটের সেই ম্যাচ নিছক একটা ক্রিকেট ম্যাচ হয়ে থাকে না। সেদিনই বোনা হয়েছিল সিপাহি বিপ্লব আর পরবর্তীতে ভারতবর্ষ স্বাধীনের বীজ।
এমন ম্যাচের কী কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই বিসিবির কাছে? বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী জানালেন, ‘‘সঠিক নথি পেলে সেগুলো সংগ্রহ করে রাখাই যায়। আমাদের ক্রিকেটের ঐতিহ্য এগুলো।’’