সরকারের সমালোচনা করে ফেইসবুক পোস্টের জন্য দুই বছর আগে আওয়ামী লীগ আমলে চাকরি হারিয়েছিলেন কবি রহমান হেনরী। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেই চাকরি ফিরে পেলেন তিনি। তবে তিনি যেদিন চাকরিতে ফিরলেন, সেদিনই ওএসডি হলেন আরেক সরকারি কর্মকর্তা তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি। কারণ একই, ফেইসবুকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে লেখা।
একই দিনে তাদের একজনের চাকরিতে ফেরা এবং অন্যজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে ফেইসবুকে চলছে আলোচনা। রহমান হেনরীর চাকরি ফেরায় যেমন সন্তোষ প্রকাশ হচ্ছে, তেমনি ঊর্মিকে নিয়ে পদক্ষেপে দেখা যাচ্ছে ক্ষোভ।
রহমান হেনরী নামে কবিতা লিখলেও তার প্রকৃত নাম মো. সাঈদুর রহমান। তিনি বিসিএস ১৫শ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। ২০২২ সালে বরখাস্ত হওয়ার সময় তিনি জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হিসাবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে উপপরিচালক ছিলেন।
২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন রহমান হেনরী। তাতে লেখা ছিল- “প্রাসাদের নিকটে এসেছি/এসে দেখছি, ভয়ানক ডাইনীকে মহান সম্রাজ্ঞী বলা হয়।”
তার এই লেখা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলে তখন সরকারের মনে হয়েছিল। সেই কারণে তাকে প্রথমে ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছিল।
দুই বছর পর ২০২২ সালের ১৩ জুন তাকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের সেই আদেশে বলা হয়েছিল- তিনি ছদ্মনামে একটি কুরুচিপূর্ণ, অশোভন ও আপত্তিকর কবিতা প্রকাশ করেন, যা একদিকে একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে অশোভন ও অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ এবং অন্যদিকে এতে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
এই কারণে সরকারি কর্মচারী বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সরকারি কর্মচারীদের সোশাল মিডিয়ায় লেখালেখি করা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল। তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও ছিল। রহমান হেনরীকে বরখাস্ত করা নিয়েও ছিল সমালোচনা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রশাসনে ওলট-পালট হচ্ছে। তার ধারায় বরখাস্ত রহমান হেনরীও চাকরি ফিরে পেয়েছেন।
গত ৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ হয়। তাতে বলা হয়, যেদিন তিনি বরখাস্ত হয়েছিলেন, সেই ২০২২ সালের ১৩ জুন থেকেই তাকে পুনর্বহাল করা হলো। আর এই সময়ে বেতনসহ অন্যান্য পাওনাও তিনি পাবেন।
তাকে চাকরিতে পুনর্বহালে সন্তোষ প্রকাশ করে সাহিত্যিক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ফেইসবুকে লিখেছেন, “সাইদুর রহমানের তিন বছর কী কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, তা আমার পক্ষে বোধগম্য।”
সাবেক সংবাদকর্মী সাইয়েদ জামিল ফেইসবুকে লিখেছেন, “ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনা যেদিন কবি রহমান হেনরীর চাকরি খেয়েছিলো, সেদিন প্রথম প্রতিবাদ করেছিলাম আমি। আজ হেনরী ভাইকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। আজ আমি প্রথম স্ট্যাটাস দিতে পারি নাই। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে সীমাহীন।”
ওই আদেশের পর রবিবারই চাকরিতে যোগ দিয়েছেন রহমান হেনরী। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কবিতা লেখার কারণে তাকে বরখাস্ত করাটা অন্যায় হয়েছিল।
আবার রবিবারই লালমনিরহাট জেলায় কর্মরত সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে ওএসডি করার আদেশ হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে।
ওএসডি করার আদেশে কোনও কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে আগের দিনই তিনি ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন, তাতে লেখা ছিল- “সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটন পুশ করা হয়েছে, অতীত মুছে গেছে … এতই সহজ! কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার মহাশয়।”
উর্মি নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন যে ওই পোস্ট তারই লেখা। লালমনিরহাট জেলার ডিসি এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ঊর্মির বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এর পরপরই ঊর্মিকে ওএসডি করার আদেশ আসে।
ঊর্মিকে ওএসডি করার আদেশে ক্ষোভ জানিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। দলটির ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে বলা হয়েছে, “ভিন্নমত সহ্য করতে পারছে না ড. ইউনুসের অবৈধ সরকার। ওএসডি করা হলো ম্যাজিস্ট্রেটকে। রিসেট বাটন চেপে বাংলাদেশের ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।”
ঊর্মিকে ওএসডি করা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করছেন আরও অনেকে।
তার প্রতিক্রিয়ায় আবার সাংবাদিক আনিস আলমগীর ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “তাকে ওএসডি (দায়িত্বহীন) করা হয়েছে। আমার আওয়ামী লীগ সমর্থক বন্ধুরা এটিকে বাকস্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন।
“তাপসী তাবাসসুম, আপনার বাকস্বাধীনতা অবশ্যই আছে, কিন্তু সরকারি চাকরির বিধিও কি নেই? ভাগ্য ভালো যে শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায় নেই, নইলে আপনি একা নয়, আপনার চৌদ্দগোষ্ঠীই জেলে যেত। তখনও আমি আপনাকে জেলে পাঠানো সমর্থন করতাম, আর এখন আপনার ওএসডি হওয়াকে সমর্থন করছি।”
ওএসডি করার একদিন পর ঊর্মিকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।