Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

তাহেরের চিঠি, মদ ও মানুষ পাচারের স্মৃতি

আফসান চৌধুরী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

মানুষকে জীবনে অনেক কিছু পাচার করতে হয়, আমাকেও করতে হয়েছে। কখনও ইচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায়। তবে পাচারকারী হিসেবে আমি তিনবার পাস করেছি। এখানে পাস করা অভিজ্ঞতাই বলছি। ফেল দু’একটায় হয়েছে, সেগুলা অন্য আর এক দিন। চিঠির গল্পটা দিয়েই শুরু করি।

২.
ঘটনা ১৯৭৬ সালের। জিয়া’র মার্শাল ল’ চলছে। এমন সময় বিচারে ফাঁসি হয় কর্নেল তাহেরের। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, একটা পা যায় যুদ্ধে। বিষয়টা নিয়ে অনেক আলাপ, আলোড়ন ওঠে। শোনা যাচ্ছিল তিনি নাকি তার স্ত্রী লুৎফাকে একটি চিঠি লেখেন এবং সেটি জেল থেকে পাচার হয়ে গেছে। ফলে এ নিয়ে বেশ কিছু তল্লাশির ঘটনাও ঘটে। এরই মধ্যে আমার এক স্যার আমাকে বাসায় ফোন করে বললেন, একটা জরুরি কাজ আছে, দেখা করতে। স্যার ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারেই থাকতেন।

৩.
আমি এমনিতেই বিকেলে ওই পাড়ায় থাকতাম, সেদিন কি কারণে বাড়িতে। তাই দেখা করতে গেলাম ক্যম্পাসে। দেখি ক্যাম্পাসে অনেক পুলিশ। এমনিতে খাকি ভাইদের হাতে, পুলিশের হাতে অনেক আপ্যায়ন গ্রহণ করতে হয়েছে আমাকে। আমার ধারণা জাসদ নেতা মেজর জলিলের সাথে চেহারার মিল থাকার কারণে। আমারও বেশ গোল-গাল চেহারা, মুখ ভর্তি দাড়ি। একবার আমার এক বন্ধু এক পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে, ‘‘চেনেন উনি কে?’’ পুলিশ লাজুকভাবে বলে, ‘‘জলিল সায়েব।’’ তাই এতো পুলিশ দেখে একটু চিন্তিত হলাম।

৪.
স্যারের বাসায় গিয়ে জানলাম কর্নেল তাহেরের চিঠি যেভাবেই হোক তখন ক্যাম্পাসে, স্যারের কাছে। তিনি জাসদ সমর্থক না, তাই সন্দেহের বাইরে। কিন্তু তল্লাশি চলছে, তাই চিঠিটা এলাকা থেকে বের করা দরকার। দলের কর্মীদের ওপর চোখ আছে, তাই এমন একজনকে দরকার যে দলের নয় কিন্তু কাউকে বিপদে না ফেলে কাজটা করতে পারবে। সে কারণেই আমি। আমি স্যারকে সালাম দিয়ে আমার বন্ধু বাংলা বিভাগের মুস্তাফাকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। একজন মানুষ শাহবাগে থাকবে, তার হাতে দিয়ে দিলেই চলবে। কঠিন কাজ নয়, ধরা না পড়লেই হলো। মুস্তাফা যাবে শাহবাগে আমার সাথে। আমরা রিকশা নিলাম।

৫.
ওর সাথে আড্ডা গল্পে আমরা এমন জমে গিয়েছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম হাতে কি। আমার হাতেই ধরা ছিল খামটা। আমরা একের পর এক পুলিশের পাহারা পার করছি— কোনও চিন্তা নাই। এটা শুধু বয়সের দোষ নয় বুদ্ধির অভাবও বটে। এমন সময় আর্টস কলেজের কাছে এসে হঠাৎ এক পুলিশ দেখি আমার হাতে ধরা কাগজের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তখন খেয়াল হলো! জলদি করে চিঠির খামটা পায়জামার ভেতর ঢুকালাম। ওটা বুদ্ধির না বেকুবির কাজ ছিল জানি না। কিন্তু পার হয়ে গেলাম। শাহবাগে লোক দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে দিয়ে আমি আবার রিকশায়। আর মুস্তাফা তার আড্ডার সন্ধানে চলে গেল।

পরে তাহেরের চিঠি পাচারের ঘটনা শুনে একজন বলেছিল, ধরলে ‘দফা রফা’ হয়ে যেত আমাদের। তবে আমার মনে হয় এরকম কয়েক কপি চিঠি চালান হয়, আমরা ছিলাম কেবল একটার পাচারের সাথে জড়িত। তবে হ্যাঁ, ধরা পড়লে, খবর ছিল। মজাটা হলো, আমরা কেউ ওই দলের নই কিন্তু তবু আমাদের বিশ্বাস করেছিল। আজকে সম্ভব?

৬.
পরে তাহেরের চিঠি পাচারের ঘটনা শুনে একজন বলেছিল, ধরলে ‘দফা রফা’ হয়ে যেত আমাদের। তবে আমার মনে হয় এরকম কয়েক কপি চিঠি চালান হয়, আমরা ছিলাম কেবল একটার পাচারের সাথে জড়িত। তবে হ্যাঁ, ধরা পড়লে, খবর ছিল। মজাটা হলো, আমরা কেউ ওই দলের নই কিন্তু তবু আমাদের বিশ্বাস করেছিল। আজকে সম্ভব? 

৭.
মদ পাচার অনেক জটিল বিষয়। কারণ এটা যাদের করতে হয় বা যারা করতে বাধ্য হয় তারা নিজেরা অনেকে সময় মাল খেয়ে ফেলে। তখন আমি ছাত্র। যাই হোক আমাকে একবার টাকা দেওয়া হয় তিন বোতল (বড়) কেরু কোম্পানির মদ কিনে আনতে। ডিলারকে অনেকেই চিনতো কিন্তু খোরগণ ঠিক একে অন্যের ওপর ভরসা রাখতে পারছিল না। যাই হোক, আমি ও আমার এক বন্ধু টাকা নিয়ে কিনতে গেলাম। কই গেলাম, বললাম না। কিন্তু বড় বোতল পেলাম না, ছোট ৭/৮ বোতল ‘নিপ’ কিনে রওনা দিলাম। রাখার জায়গা নাই তাই ছাতার ভেতর রেখে রিকশায় উঠলাম। কাচের বোতলগুলা বেশ সুন্দর, একে অন্যের গায় ধাক্কা লেগে টুং টাং শব্দ করে জল তরঙ্গ বাজাচ্ছে।

৮.
সবই ঠিক ছিল কিন্তু বিপদ হলো ‘ইন্টারকন’ হোটেলের কাছে এসে। হঠাৎ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। সেটা হতেই পারে। কিন্তু রিকশায় বসা দুই তরুণ কেন হাতে ছাতা ধরে বসে আছে, মাথায় ধরছে না, সেটা নিশ্চয় হোটেলের সামনে দাঁড়ানো পুলিশটাকে খুব চিন্তিত করে। আমরা দুজনে যে কী রকম সিরিয়াস মুখ করে, আল্লার নাম নিয়েছিলাম তা বলা যাবে না। পুলিশ হতভম্ব হয়ে দেখছে— কাছে গেলে বোতলের আওয়াজ পর্যন্ত পেল কিন্তু তার চেহারায় যে আশ্চর্যভাব ছিল সেটা কাটার আগেই আমরা পার হয়ে যাই। আর মাল পৌঁছে দেবার পর কত গালি দিছিলাম বন্ধুদের বললাম না।

৯.
মানুষ পাচারটা অনেক জটিল ছিল। কিন্তু তখন মনে হয়নি। ১৯৯০-এর কথা। কিছু চীনা ছেলে দেশে আটকে পড়ে, কারণ তারা তাদের দেশের সরকারবিরোধী ‘ডেমো’ করেছিল। এক্সিট ভিসা দিচ্ছিল না বাংলাদেশ সরকার, কিন্তু তাদের অ্যাসাইলাম হয়ে গেছে  সুইৎজারল্যান্ডে। যাবে কিভাবে? আমার কাছে নিয়ে আসে এক বন্ধু। আমরা সকল কিসিমের মানুষকেই জানি তাই টাকার বদলে পাসপোর্ট ভিসা বানাতে কষ্ট হয়নি। বেনাপোল দিয়ে একটা রিহার্সাল করতে বললাম ফলস পাসপোর্ট দিয়ে। বলল,লাগবে না। ওরা তো চীনা না চাকমা, অতএব নো প্রব্লেম। সাথে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। দালাল জানালো বর্ডারে গিয়ে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে, তাই বাংলায় কথা বলতে হবে না। খালাস। ওরা সেই বিদেশ থেকে একটা ধন্যবাদ পত্র লিখেছিল। তারপর তো খোদ চীনেই সরকার পাল্টে গেল।  

তিন কিসিমের পাচার করলাম, প্রফিট ছাড়া। এই হয়।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত