বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের তখন টালমাটাল অবস্থা। একের পর এক ফুটবলার জাতীয় দলের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বাড়িতে। ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন মায়ের অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন চীনে। স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্না অনেক অভিমান নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। দলের আরেক স্ট্রাইকার তহুরা খাতুনও বাফুফে ভবন ছেড়ে চলে গেলেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের বাবার কাছে।
ফুটবল ছাড়তে চেয়েছিলেন তহুরা
বছরখানেক আগে কোনও একটা কারণে মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়েন তহুরা। এর ওপর ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে পারতেন না। শরীরের ওজন দ্রুতই কমে যাচ্ছিল। ফিটনেস ঠিক থাকতো না। সঙ্গে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া। ফুটবল খেলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন তহুরা।
কিন্তু তহুরাকে ফুটবলে ফেরাতে চেষ্টা চালিয়ে যান জাতীয় দলের সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু। ওই অবস্থায় জাতীয় কোচদের সহযোগিতা না পেলে হয়তো ফেরায় হতো না তহুরার। বাংলাদেশ দলও হারাতো এমন গতিময় স্ট্রাইকারকে।
১৩ বছরে ৯ গোল
জাতীয় দলের আক্রমণভাগে সব সময়ই সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের প্রথম পছন্দ থাকতেন অবসরে যাওয়া সিরাত জাহান স্বপ্না, মিশরাত জাহান মৌসুমী বা কৃষ্ণা রানী সরকার। এমনকি জুনিয়র শামসুন্নাহারও খেলতেন নিয়মিত একাদশে। কিন্তু তহুরা বেশিরভাগ ম্যাচে খেলতেন বদলি হিসেবে। যে কারণে ১৩ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের জার্সিতে তহুরার গোল মাত্র ৯ টি।
তারপরও কিন্তু সব মিলিয়ে তহুরার গোলসংখ্যা একেবারে কম না। জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দল মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৫২ গোল করে ফেলেছেন তহুরা। এর মধ্যে ৪৩টি গোল করেছেন সাফ ও এএফসির বিভিন্ন বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা।
বুধবার কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় সাফে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেছেন জোড়া গোল। ৩-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে জিতে নিয়েছেন সেরা ফুটবলারের পুরস্কার।
কোন দেশের বিপক্ষে কত গোল তহুরার
জাতীয় দলের হয়ে তহুরার প্রথম গোল ২০২১ সালে। উজবেকিস্তানে এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে অংশ নেওয়ার আগে নেপালে দুটি ফিফা প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয় বাংলাদেশ। কাঠমান্ডুতে ওই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ২-১ গোলে। কিন্তু ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন তহুরা।
এরপর উজবেকিস্তানে বাংলাদেশ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রথম ম্যাচে হংকংকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে ৪ গোল করেন সাবিনা খাতুন। অন্য গোলটি ছিল তহুরার।
তহুরা পরের গোলটি পান এক বছর পর নেপালেই। নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে বদলি নেমে তহুরা করেন ১টি গোল।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় কমলাপুর স্টেডিয়ামে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দুটি ফিফা প্রীতি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। সেখানে ১ ডিসেম্বর প্রথম ম্যাচে তহুরা করেন জোড়া গোল। ওই ম্যাচটি বাংলাদেশ জেতে ৩-০ গোলে। এরপর ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করে সিঙ্গাপুরকে। যেখানে আবারও জোড়া গোল করেন তহুরা।
এরপর দশরথ রঙ্গশালায় বুধবার দুটি গোল করেছেন তহুরা। ২০ অক্টোবর পাকিস্তান ম্যাচে একাধিক সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেননি। ভারত ম্যাচে সিনিয়রদের সুযোগ দিতে তাকে না খেলানোর পরিকল্পনা করেন কোচ পিটার বাটলার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনায় বদল এনে শুরু থেকেই তহুরাকে নামিয়ে দেন।
কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে তহুরা সময় নিলেন ২৯ মিনিট। এরপর ৪২ মিনিটে আরও একটি গোল করে ভারতের জয়ের স্বপ্নে জল ঢেলে দেন।
বিভাজনের দেওয়ালে সেতুবন্ধন তহুরা
পাকিস্তানের বিপক্ষে ড্রয়ের পর কোচ ও সিনিয়র খেলোয়াড়দের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব। আর সেই দূরত্ব দূর করতেই ভারতের বিপক্ষে শতভাগ নয়, তার চেয়েও বেশি দিতে চেয়েছিলেন।
দুর্দান্ত পারফরম্যান্স শেষে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন তহুরা। যে পুরস্কার তিনি উৎসর্গ করেন সদ্য প্রয়াত তার এক বন্ধুকে।
তহুরাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের
আক্রমণভাগে স্বপ্নার অভাবটা পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই টের পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর আর সেই অভাব বুঝতে দেননি তহুরা। কে জানে হয়তো এবারের সাফে তহুরাই লিখবেন শিরোপা জয়ের অন্য রকম গল্প!