দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের ছোট্ট একটি দ্বীপ দেশ তাইওয়ান। কয়েক বছর আগে দ্য ইকোনমিস্ট এই দেশটিকেই পৃথিবীর সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক স্থান’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। যেসব কারণে ইকোনমিস্ট তা বলেছিল, সেগুলো এখনও অটুট। এমনকি সেই কারণগুলো আরও শক্তিশালী হয়েছে এখন।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলেই তাইওয়ান নিয়ে এই উত্তেজনা। প্রথমে চীনা নেতা শি জিনপিং এবং তারপরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর থেকে উভয় দেশই মৌলিকভাবে পরস্পরের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করেছে। বন্ধুভাবাপন্ন থেকে তা গড়িয়েছে সতর্কতা ও শত্রুতার দিকে।
সম্ভবত অর্থনৈতিকভাবে চীনের অস্বাভাবিক ও দ্রুত বেড়ে ওঠা এবং আমেরিকার প্রভাবশালী অবস্থানের বাস্তবতা এই শত্রুতাকে অনিবার্য করে তুলেছে। কোনও উদীয়মান বিশ্ব শক্তি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব শক্তির মুখোমুখি হলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা শেষমেষ যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে। লেখক ও হার্ভার্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক পণ্ডিত গ্রাহাম অ্যালিসন যেমনটা বলেন।
কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ কি অনিবার্য? একদিক থেকে দেখলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধকে অস্বাভাবিক মনে হয়। কারণ ভূ-রাজনৈতিকভাবে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও অর্থনৈতিকভাবে দেশ দুটি পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার বাণিজ্যিক লেনদেন যখন শীর্ষে ছিল, তখনও দেশ দুটি বছরে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় করেছিল। আর এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্র মাত্র কয়েক দিনেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা এবং বাণিজ্যে বিধি-নিষেধ বাড়ার পরেও এই সংখ্যা খুব একটা কমেনি।
এছাড়া চীনকে এমন কোনও বিপ্লবী রাষ্ট্র বলে মনে হয় না, যারা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে এবং আমেরিকার বিকল্প মতাদর্শ নিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চায়। স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রে যে মতাদর্শগত বিরোধ ছিল, তা আজ অনেকাংশেই অনুপস্থিত।
তবে একটা ব্যাপার রয়েছে- পারমাণবিক প্রতিরোধ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যেও এই কারণেই সর্বাত্মক যুদ্ধ বাধেনি। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও পারমাণবিক অস্ত্র একই ভূমিকা পালন করতে পারে।
তারপরও যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের কেন্দ্রে তাইওয়ানের মতো জ্বলন্ত সমস্যা রয়েছে।
তাইওয়ান যে একটি স্বাধীন দেশ হতে পারে, তা চীন কখনোই মেনে নেয়নি। এটি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উদ্ভাবন নয়। বিষয়টি চীনের সংবিধানেই রয়েছে। মাও সেতুং থেকে শুরু করে চীনের সব রাষ্ট্রপ্রধানই তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে গেছেন।
তবে অতীতে কমিউনিস্ট চীনের বিশ্বাস ছিল, সময় যেহেতু তাদের অনুকূলে আছে, তাই তারা চাইলে আরও অপেক্ষা করতে পারে। এমনকি অবশেষে হয়ত বিশাল অর্থনীতি ও শত কোটির বেশি জনসংখ্যাসহ চীনের মূল ভূখণ্ড মাত্র ২ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার ক্ষুদ্র দ্বীপটিকে তার কক্ষপথেই টেনে নিয়ে আসবে।
এটাই ছিল চীনের ভাবনা। কিন্তু সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। তাইওয়ান চীনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটা দিয়েছে। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের বদলে তাইওয়ান পুরোপুরি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনের প্রভাব থেকে ১০০ হাত দূরে থেকেছে।
এমনকি গত কয়েক দশক ধরে তাইওয়ান চীনের সঙ্গে পুনর্মিলিত না হওয়ার জন্য আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। সুতরাং শি জিন পিং অবশ্যই এই পরিস্থিতি দেখছেন এবং অনুভব করছেন যে, সময় আর তাদের পক্ষে নেই। তাই সম্ভবত অবিলম্বে পদক্ষেপ নিলেই ভালো হবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় মিত্রদের কাছে তাইওয়ানকে পুনরুদ্ধারে চীনের আগ্রাসন গ্রহণযোগ্য হবে না। চীন যদি জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাইওয়ানকে তার সঙ্গে যুক্ত করতে পারে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের উপর চীনের দাবি মেনে নেব, অন্যথায় নয়।
সব পক্ষের জন্যই, তাইওয়ান নীতি বর্তমানের কোনও বাস্তব পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ভবিষ্যতের কল্পনাকে সহ্য করার বিষয়ে। তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষও কেবল স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে এবং সবকিছু যেমন আছে তেমনই রাখতে চায়। যদিও সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর এমন একটি দল তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে যারা একটি স্বাধীন তাইওয়ানের ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো দলটি মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বাকি ৬০ শতাংশ এমন দুজন প্রার্থীর পক্ষে গেছে যারা কম স্বাধীনতা-মনস্ক।
এর মানে কী? এর মানে হলো, সমস্যাটি সমাধানের পরিবর্তে ম্যানেজ করতে হবে এবং বেইজিং ও ওয়াশিংটন উভয়কেই খুব সাবধানতার সঙ্গে চলতে হবে। এটি পৃথিবীর এমন একটি জায়গা যেখানে পুরুষালি বক্তৃতা ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য খুব কম সুযোগ থাকা উচিৎ। যাতে কোনও ভুল বোঝাবোঝি না হয় তা নিশ্চিত করতে তিনটি পক্ষেরই পরস্পরের সঙ্গে খোলামনে কথা বলা উচিৎ।
এর কোনওটাই নৈতিকভাবে সন্তোষজনক নয়। কিন্তু ঝুঁকি বেশি হওয়ায় একটা বিষয় পরিষ্কার- তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনাগুলো যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়, এই সংঘর্ষ যদি যুদ্ধে গড়ায়, তাহলে তিন পক্ষেরই লোকসান হবে। এতে কোনও পক্ষেরই লাভ হবে না। এমনকি এর ফলে সমগ্র বিশ্বও বিপর্যয়কর পরিণতি ভোগ করবে। ফলে যতক্ষণ সম্ভব একে বাড়তে না দেওয়াই ভাল, যাতে এতে বিস্ফোরণ না ঘটে।
[সিএনএনে প্রকাশিত ফরিদ জাকারিয়ার কলাম]