Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভূমিকম্প : দুই দশকের প্রস্তুতি যেভাবে বাঁচাল তাইওয়ানকে

গত বুধবার তাইওয়ানে ভূমিকম্পে হেলে পড়া ১০ তলা একটি ভবন। ছবি: এএফপি।
গত বুধবার তাইওয়ানে ভূমিকম্পে হেলে পড়া ১০ তলা একটি ভবন। ছবি: এএফপি।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

পৃথিবীর কোথাও বড় ভূমিকম্প হলে বিশ্ব মিডিয়া সেখানে যেন মাছির মতো ছুটে যায়। ভূমিকম্প সবচেয়ে নাটকীয় একটি প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ, তাই এর প্রতি মিডিয়ার এমন মনোযোগ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রায়ই প্রকৃতপক্ষে যা ঘটে মিডিয়া তার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারে না।

সম্প্রতি তাইওয়ানের হুয়ালিয়েন শহরে আঘাত হানা ভূমিকম্পের বেলায়ও তাই ঘটেছে। মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো সব ভয়ঙ্করভাবে হেলে পড়া একটি ১০ তলা ভবনের চারপাশে ভিড় করছে। দৃশ্যটি দেখতে উদ্ভট এবং ভীতিকরও। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো ৭.৪ মাত্রার মতো একটি বড় ভূমিকম্পেও এবার মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ভবন কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি ছিল তার একটি। শহরটিতে হাজার হাজার ভবন রয়েছে।

ভবনটির চারপাশের পুলিশ কর্ডন ছাড়িয়ে মাত্র একশ মিটার দূরে হুয়ালিয়েনের রাস্তাগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। দোকানপাট ও ক্যাফে খোলা। রাস্তায় যানবাহন চলছে। এমনকি শহরের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলে আপনি যদি আগে থেকে না জানেন যে কয়েকদিন আগে একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, তাহলে আপনি তা বুঝতেও পারবেন না।

এতো বড় ভূমিকম্পেও যে শহরটি অনেকাংশেই অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে, তা কীভাবে এবং কেন সম্ভব হলো তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা শুরু হয়েছে।

মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে আমরা তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রায় একই মাত্রার ভূমিকম্প দেখেছি। ওই ভূমিকম্পে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় ভূমিকম্প মোকাবেলায় ওই দেশগুলোর সক্ষমতা অনেক কম ছিল, তা ঠিক। কিন্তু ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে মাত্র ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পেও পুরো শহরের কেন্দ্রস্থল মাটিতে মিশে যায়। অথচ নিউজিল্যান্ড একটি শীর্ষস্থানীয় ধনী দেশ।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকটোনিক প্লেটের ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত হওয়ায় তাইওয়ানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। তবে দেশটি ঝাঁকুনি মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অনেকেই বলেন, ১৯৯৯ সালের ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের পরই তাইওয়ান এই বিষয়ে সজাগ হয়। সেই ভূমিকম্প দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ছিল। ওই ভূমিকম্পে ২ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং কয়েক হাজার ভবন ধ্বংস হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল, সেই ভূমিকম্পে শত শত নতুন ভবনও ধসে পড়েছিল। কিছু নতুন ভবন শুধু ভিত থেকে উপড়ে পড়ে যায়।

ওই বিপর্যয়কর ক্ষয়ক্ষতি অনেক ক্রোধ এবং আত্ম-অনুসন্ধানের উদ্রেক করে যে, কেন এতগুলো নতুন ভবন ভেঙে পড়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সেগুলোর নকশায় মৌলিক ত্রুটি ছিল। ভিত্তি স্তম্ভগুলো যথেষ্ট বড় ছিল না, এসব ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত ইস্পাতের পরিমাণও খুব কম ছিল।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা তথ্যগুলো বিস্ময়কর ছিল না। ১৯৯০-র দশকে তাইপেতে প্রায়ই ভবন নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির খবর আসত।

প্রায়ই ভবন নির্মাণে নদীর বালুর পরিবর্তে সমুদ্রের বালু ব্যবহারের অভিযোগ উঠত। সামুদ্রিক বালু নদীর বালুর তুলনায় অনেক সস্তা এবং এতে লবণাক্ততার পরিমাণও অনেক বেশি। অতিরিক্ত লবণ ইস্পাত বারগুলোকে দ্রুত ক্ষয় করে কংক্রিটের ক্যান্সার সৃষ্টি করে। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও এমন একটি ভবন ধসে পড়বে।

তাইপেই শহরের মেয়রের এক তদন্তে একবার দেখা যায়, একটি নতুন ভবনের কংক্রিটের স্তম্ভের ভেতরে পুরোনো তেলের ক্যান ভরে রাখা হয়েছে। কম কংক্রিট দিয়ে মুনাফা বাড়ানোর জন্য এই কৌশল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল নির্মাণ সংস্থার বিরুদ্ধে।

তবে এরপর থেকে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। চি চি ভূমিকম্পের পর বিল্ডিং কোড পরিবর্তন করা হয়।

সমস্ত নতুন ভবনকে এখন একটি মৌলিক ভূমিকম্প প্রতিরোধ স্তর পূরণ করতে হয়, যাতে সেগুলো বড় কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট স্তরের কম্পন সহ্য করতে পারে।

সরকারও প্রতিনিয়ত ভবনগুলোর প্রয়োজনীয় ভূমিকম্প প্রতিরোধের স্তরগুলোকে সংশোধন করে। যেসব ভবনের সংস্কার প্রয়োজন সেগুলোকে চিহ্নিত করে নতুন করে কাজ করা হয়। ১৯৯৯ সালের পর থেকে কোনও ভবন নির্মাণের সময় বাড়তি ভূমিকম্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। যেমন, ভবনের বাইরের অংশে ইস্পাত বিমের কাঠামো যুক্ত করা বা অতিরিক্ত ভিত্তি স্তম্ভ যুক্ত করে ভবন শক্তিশালীকরণ করার মতো বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়। সেতুর মতো অবকাঠামোগুলোতেও এই বাড়তি নিরাপত্তা প্রযোজ্য।

কয়েক দশক ধরে দেশের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ বিভাগে কাজ করা ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইহ-মিন উ বলেছেন, “তাইওয়ানে এতো ঘন ঘন বিপজ্জনক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে যে, বেশিরভাগ নিম্নমানের ভবন ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।”

দেশটিতে ভবন নির্মাণকাজে দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করা হয়। ২০১৬ সালে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে তাইনান ভূমিকম্পে একটি ১৭ তলা উঁচু ভবন ধসে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভবনটির নির্মাণের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।

গত বুধবারের ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এর মধ্যে মাত্র একজনের মৃত্যু হয়েছে ভবন ধসে পড়ার কারণে। হুয়ালিয়েনের সেই ১০ তলা ভবনটিতে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাকি ৯ জনের মৃত্যু হয় ভূমিধস ও পাহাড় থেকে পাথরধসের কারণে।

তবে এবারের ভূমিকম্পে সীমিত ক্ষয়-ক্ষতির পেছনে ভাগ্যও একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। বুধবারের ভূমিকম্পটি নিকটতম জনপদ হুয়ালিয়েনের দক্ষিণে আঘাত করার আগে উপকূল থেকে কিছুটা দূরে শুরু হয়েছিল।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল শহরের দক্ষিণ সীমানা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল। ফলে হুয়ালিয়েন ও এর পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ কম্পন থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

তবে দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়, যার ফলে সেখানে বিশাল পাথরধস ঘটে এবং রাস্তা ও সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুঃখজনক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

বুধবারের ভূমিকম্পটি ১৯৯৯ সালে তাইওয়ানের নানটো এবং গত বছরের তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের মতো জনপদের খুব কাছে আঘাত হানেনি। ওই ভূমিকম্পগুলো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের খুব কাছাকাছি আঘাত হানায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

তথাপি ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পটি অনেক শক্তিশালি ছিল, যা কেবল পুরো তাইওয়ান দ্বীপকেই নয়, বরং এর বাইরেও ভূমিকে কাঁপিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রম তাইওয়ান এবার ভূমিকম্প মোকাবেলায় অনেক ভালোভাবে প্রস্তুত ছিল।

তাইওয়ানের ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতির অন্যান্য স্তম্ভ

প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা: দ্বীপের চারপাশে স্থাপিত সেন্সরগুলো ভূমিকম্পের প্রথম কম্পন শনাক্ত করে ভূমিকম্প আঘাত হানার ২-৮ সেকেন্ড আগে কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা জনসাধারণকে মোবাইল ও টিভিতে সতর্ক করতে পারে। তবে সিস্টেমটি এখনও সমস্যায় ভুগছে। এবার তাইপের বাসিন্দারা ফোনে সতর্কবার্তা পাননি।

জনসচেতনতা : ১৯৯৯ সালের পরে তাইওয়ানের সব স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে তারা জানে ভূমিকম্পের সময় জীবন বাঁচাতে কী করতে হবে।

দ্রুত সাড়া : দেশটির দুর্যোগ মোকাবেলা টিমগুলো সক্রিয়ভাবে সোশাল মিডিয়া ট্র্যাক করে এবং ক্ষতির মূল্যায়ন করতে নজরদারি ক্যামেরায় রেকর্ড করতে পারে। এর মাধ্যমে কোনও স্থানে দ্রুত সাহায্য পাঠাতে হবে তা নির্ণয় করতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত