এশিয়ার ছোট্ট একটি ভূখণ্ড তাইওয়ান। কিন্তু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণে এর গুরুত্ব এখন অনেক। এই দেশটিতে শনিবার নির্বাচন।
চীনের চাপ নিয়েই দেশটির নাগরিকরা তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বাছাই করবেন। এই নির্বাচনের দিকে শ্যেন দৃষ্টি রাখছে যেমন বেইজিং; তেমনি কড়া নজর থাকছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর।
ফলে শনিবারের এই ভোটযুদ্ধ শুধু তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের লড়াইয়ের একটি ক্ষুদ্র মঞ্চও হয়ে উঠেছে।
তাইওয়ানের জনগণের বেশিরভাগই চীনা বংশোদ্ভুত। তবে তারা চায় না চীনের শাসনে থাকতে। ওদিকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে বেইজিং ক্রমশ তার প্রতিবেশীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে।
চীনের প্রশাসন প্রকাশ্যেই তাইওয়ানের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করে। এবার নতুন বছরের ভাষণে শি’কে বলতে শোনা গিয়েছিল, “তাইওয়ানকে যুদ্ধ এবং শান্তি, উন্নয়ন এবং অবনতির মধ্য থেকে পছন্দ বেছে নিতে হবে। মূলভূমির সঙ্গে পুনর্মিলন ঐতিহাসিকভাবেই অনিবার্য।”
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনার অন্যতম উৎস তাইওয়ান। দুই পরাশক্তির ক্ষমতার দৌড়ে তাইওয়ান এখানে শুধুই জকি। তারপরেও এবারের নির্বাচনে দেশটির ভোটাররা শেষ পর্যন্ত তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভোট দেবে।
এজন্য তাদের আন্তর্জাতিক চাপের ভারসাম্য বজায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, তাইওয়ানে বৈধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে সংঘর্ষ এড়ানো কঠিন হবে।
তবে এই নির্বাচন একদিকে এই অঞ্চলের এবং বৈশ্বিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে।
নির্বাচনে দেশটির নাগরিকরা তাদের পরবর্তী নেতা হিসেবে এমন ব্যক্তিকেই ভোট দেবেন, যিনি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়ক হবেন। কিন্তু ভোটের দিন প্রত্যেক ভোটারকেই চীন-তাইওয়ান সম্পর্ক এবং ভূ-রাজনীতি মাথায় রেখে ভোটটি দিতে হবে।
নির্বাচনে প্রার্থী যারা
ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসবে কি না, তা অনিশ্চিত। কারণ মেয়াদ সংক্রান্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দলটির বর্তমান নেতা ও প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন ভোটে দাঁড়াতে পারেননি। তার জায়গায় ডিপিপির হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট লাই চিং তি।
স্বাধীনতাকামী লাইয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি ইতোমধ্যেই ভোটারদের একাধিকবার চীনা সেনাবাহিনীর হুমকি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। পাশাপাশি ক্ষমতায় এলে সাই ওয়েনের মতোই চীন প্রশ্নে তিনি কৌশলী ভূমিকা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
নির্বাচনে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নিউ তাইপে সিটির মেয়র ও কুমিনতাং পার্টির (কেএমটি) নেতা হউ ইউ-ইহ। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য।
তার মতে, এবারের নির্বাচনে তাইওয়ানের ভোটারদের শান্তি অথবা সংঘর্ষের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।
ক্ষমতা পেলে তিনি চীনের সঙ্গে ফের ‘ক্রস স্ট্রেইট সার্ভিস ট্রেড’ চুক্তি করবেন বলেও জানিয়েছেন। ২০১৪ সালে চীনবিরোধী সানফ্লাওয়ার মুভমেন্টের সময় চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছিল।
এর বাইরে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন তাইপের সাবেক মেয়র ও তাইওয়ান পিপলস পার্টির (টিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা কো ওয়েন জে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাইরে তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিতেই তার গুরুত্ব।
এই তিন প্রার্থীর বাইরে আরও কয়েকজন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তাদের জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
রাজনীতিতে কো ওয়েনের প্রভাব
চীন বিরোধিতার প্রশ্নে তাইওয়ানে ডিপিপি’র জনপ্রিয়তা অনেক। কিন্তু গত কয়েক বছরে অঞ্চলটিতে আবাসন থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি নাভিঃশ্বাস তুলেছে স্থানীয়দের।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এবারের নির্বাচনে ডিপিপি ও কেএমটির ইশতেহারে নেই। যদিও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তাইওয়ানের জনগণ মূল্যস্ফীতি নিয়েই সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত।
ফলে এবার বড় দুই দলের বাইরে টিপিপি জায়গা করে নিতে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন কোভিড টিকা কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতাসহ একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত, যা কো ওয়েনের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করেছে। দেশটির মূলধারার রাজনীতিতে বহিরাগত হয়েও তিনি এখন ক্ষমতার নির্ণায়ন হয়ে উঠেছেন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তাইওয়ান স্টাডিজের গবেষক জিং বো জিউন বলেন, “তরুণ ভোটারদের মধ্যে যাদের কোনও রাজনৈতিক পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক নেই, ডিপিপি এবং কেএমটির আমলে যাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি, তারাই কো ওয়েনের শক্তি।”
চীনের চাপ
তাইওয়ানের রাজনীতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই চীনের ব্যাপক প্রভাব। চীন সরকার প্রতি পাঁচ বছর পরপর যে নীতিমালা প্রণয়ন করে, সেখানে তাইওয়ানের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত থাকে। বেইজিং মনে করে, তাইওয়ান তাদের মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি প্রদেশ।
তাইওয়ানকে চীনের অংশ করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে দেখেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনোমিক কোঅপারেশনের গত নভেম্বরের সম্মেলনের ফাঁকে শি জিনপিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে আলাপ হয়েছিল। শি সেসময় বাইডেনকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাইওয়ান হলো চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়।
২০১৪ সালে তাইওয়ানে ছাত্র আন্দোলনের জেরে অঞ্চলটির ওপর চাপ বাড়ায় বেইজিং। তার ধারাবাহিকতায় সাই ইং ওয়েনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় বেইজিং প্রশাসনের। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি গত কয়েক বছর ধরেই অঞ্চলটির ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়াচ্ছে।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে গেলে তানিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে চীন। পাল্টা পদক্ষেপে তাইপের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল বেইজিং।
তখন বেইজিং চেয়েছিল তাইপে যেন তাদের ‘এক চীন’ নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু তা করেনি তাইপে। এই নীতি অনুসারে চীন বিশ্বাস করে, একদিন তাইওয়ান তাদের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিলিত হবে।
এরপর তাইওয়ানের ওপর চাপ বাড়াতে অঞ্চলটির জল ও আকাশসীমার পাশে একাধিকবার সামরিক মহড়া দেয় চীন। প্রায় ৩৮০ বার চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। সাই প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে মঞ্চে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইপেকে প্রতিরক্ষা সহায়তার নামে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করিয়ে নেয় ওয়াশিংটন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে ডিপিপি জিতলে তাইওয়ান প্রণালীতে চীনা সেনা উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। অবশ্য তাদের অনেকেই মনে করেন, তাইপে ও বেইজিংয়ের মধ্যে যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির এই সময়ে চীন কোনও যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তাইওয়ানকে এখনও স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু দেশটির স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। ওয়াশিংটন চায়, তাইওয়ান প্রণালীতে বাণিজ্যিক জাহাজের অবাধ চলাচল।
তাইওয়ানের একদিকে জাপান, অন্যদিকে ফিলিপিন্স ও দক্ষিণ চীন সাগর। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে তাইওয়ানের বিকল্প নেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ভূখণ্ডটি দখল করে চীন সেখানে সামরিক ঘাঁটি বানালে ইন্দো-প্যাসিফিকে আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও তাইওয়ান প্রণালীর গুরুত্ব অনেক। এই প্রণালী দিয়ে বছরে ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বেশি পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই ৬০ বিলিয়ন ডলার। ফলে তাইওয়ান অশান্ত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর বাজার হারাতে।
এজন্যই তাইওয়ান নিয়ে কৌশলী ওয়াশিংটন। চীনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নস গত ডিসেম্বরে তাইওয়ান নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, “তাইওয়ানে কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত নয় এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না।”
কূটনীতির বাইরেও তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অবস্থানও রয়েছে। ওই অঞ্চলের সাগরে রয়েছে তাদের বিশাল নৌবহর। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে তাদের সামরিক ঘাঁটি তো আছেই।
চীন যদি তাইওয়ানে আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এমনকি জাপান যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কোনও পদক্ষেপ নেবে কি না, তাও অনিশ্চিত।
এ বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হন, সেক্ষেত্রে পুরো ছকই পাল্টে যেতে পারে। তিনি হয়ত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েও যেতে পারেন চীনের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নির্বাচনে কেএমটি জিতলে দেশটিতে চীনের প্রভাব বাড়বে। আর তা হলে পরিস্থিতি পৌঁছতে পারে আরও উত্তেজনাকর পর্যায়ে।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট