ঢাকার মোহাম্মদপুরে নূরজাহান রোডের মাঝামাঝি এক জায়গায় সৌম্যকান্তির প্রৌঢ় এক ব্যক্তি প্রতিদিন নিয়ম করে আসেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। চুপচাপ থাকেন। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে কাউকে যেন খোঁজেন তিনি। কাকে খোঁজেন?
জানা গেল, নূরজাহান রোডের ঠিক সেই জায়গাতেই ১৯ জুলাই দুপুরে তার একমাত্র ছেলে মাহমুদুর রহমান সৈকত মারা যায়, পুলিশের গুলিতে।
কতই বা বয়স ছিল তার। ১৮ কী ১৯। সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।
অনেক আদরের ছেলেকে হারিয়ে জীবন যেন থমকে গেছে মাহবুবের রহমানের। জানেন, মৃতরা কখনও ফিরে আসে না। তারপরও কী এক আশায় ছেলে যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল, সেখানে ফিরে ফিরে আসেন।
একদিন দুপুরে মাহবুবের রহমানকে সেখান থেকে একটু এগিয়ে ‘দই ঘর’ নামে এক দোকানে বসে থাকতে দেখা যায়। এটা তারই দোকান। আনমনে মোবাইল ফোনে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। কল ধরে নিস্তেজ গলায় বললেন, “খাব, পরে খাব। ক্ষুধা লাগুক…”
এরপর কল কেটে ফোনের গ্যালারিতে গেলেন। দেখালেন পরানের ধন সৈকতের ছবি। একটার পর একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, “আমার ছেলে। সবার ছোট। কিন্তু সবার চেয়ে লম্বা।”
আর কিছু বললেন না। থেমে গেলেন।
মাহবুবের রহমানের পরিবারের সদস্যরা জানালেন, তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করেন না।
সৈকতের মারা যাওয়ার দিনের ভিডিও জোগাড় করতে পেরেছে তার পরিবার। একটিতে দেখা যায়, নূরজাহান রোডের মাথায় পুলিশ আর ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের মাঝে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সৈকত। হঠাৎ সে পড়ে যায়।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, রিকশায় তোলা হচ্ছে সৈকতের নিথর দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর।
খবর পেয়ে ছোট ছেলেকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে পুরো পরিবার। শেষমেশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার দেখা মেলে।
উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত ছেলেটি সেখানে নিশ্চল পড়ে ছিল। সারা গায়ে রক্ত। মাথার ব্যান্ডেজটাও রক্তে লাল। গলার কাছে লাগা গুলি মাথা ভেদ করে বের হয়ে গেছে। বেরিয়ে গেছে মগজ। এ দৃশ্য সৈকতের আপনজনদের দেখতে হয়েছে। এর ভার নিতে হয়েছে।
তার মামাতো ভাই সাইফুর আর হায়দার কনক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের পরিবারটা যৌথ। মামাতো, ফুপাতো ভাই-বোনরা সব একসঙ্গে বড় হয়েছি। এজন্য পরিবারের প্রতিটি মানুষের শোক কারও চাইতে কারও কম নয়। সৈকতের মৃত্যুতে কে কাকে সান্ত্বনা দেবে?”
এই যৌথ পরিবারের সবার ছোট সন্তান হওয়ায় অঢেল আদর-যত্নের মধ্যে বেড়ে ওঠে সৈকত। বাড়িতে এমন কোনও ঘর নেই, যেখানে সৈকতের পছন্দের কোনও খাবার রান্না হয়েছে অথচ তার জন্য রাখা হয়নি। সব ঘরে তার জন্য আলাদা বাটি রাখা ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের দোকান ‘দই ঘরে’-ও বসত ১৯ বছরের সৈকত।
কী ঘটেছিল সেদিন
১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। মাহাবুবের রহমান সেসময় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। বাবা ঢাকায় না থাকায় জুমার নামাজের পর ‘দই ঘর’-এ যান সৈকত। দোকান খোলার পর টের পান, নূরজাহান রোডের মাথায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে।
হঠাৎ সৈকতের কানে আসে, তার এক বন্ধুর গায়ে গুলি লেগেছে। তাড়াতাড়ি সে দোকানের দরজা টেনে বের হয়ে যায় বন্ধুর খোঁজে।
সৈকতের মামাতো ভাই কনক বলেন, “সেদিন নামাজ আদায় শেষে গলির মুখে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে মাত্র ভাত খেতে বসেছি। ঠিক তখন আমার মামা অর্থাৎ সৈকতের বাবা ফোন করেন। কান্নাভেজা গলায় কিছু একটা বলতে চান। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যা করায় মামা কী বলছিলেন, বুঝতে পারিনি। এরপর ফোন আসে মামির। তিনি জানান, সৈকতকে পাওয়া যাচ্ছে না।
“মাত্র ভাতে হাত দিয়েছি। মামির কথা শুনে হাত ধুয়ে কিছু টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। মায়ের মন কি না জানি না, মামিকে পেলাম গলির মুখেই। তিনি আমাকে বললেন, সৈকতকে না পাওয়ায় তাকে খুঁজতে বের হয়েছেন। আমি তাকে ঘরের ভেতরে যেতে বলে নূরজাহান রোডের মাথায় গেলাম।”
সৈকতের মা আফরোজা রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেদিন দুপুরে ছেলেটাকে ভাত খেতে দিলাম। খেয়ে দোকানে যাবার সময় বলে গেল, ‘যাচ্ছি।’
“এরপর আমি নামাজে বসলাম। হঠাৎ মনটা কেমন জানি করা শুরু করল। ছেলেকে ফোন দিলাম নামাজে বসেই। সে ফোন ধরছিল না। ওর বাবাকে তখন ফোন দিয়ে বললাম, ‘সৈকত আমার ফোন ধরছে না।’
“এরপর নামাজ রেখেই আমি ছুটলাম রাস্তায়। নূরজাহান রোডের মাঝামাঝি গিয়ে দেখি, উপর দিকে টিয়ার শেল মারছে। সামনের দিকে আগাতে পারছি না। চোখ-মুখ সব জ্বলছে। গুলির শব্দ শুনছি।”
হঠাৎ নূরজাহান রোডের মাথায় এক গুলিবিদ্ধ কিশোরের নিথর দেহ ঘিরে ছোটখোটো ভিড় চোখে পড়ে আফরোজা রহমানের। তিনি জানতেন না, সেই কিশোর আর কেউ নয়, তারই ছেলে।
আফরোজা রহমান বলেন, “সৈকতের খোঁজ দিতে পারে এমন কাউকে খুঁজছিলাম। কিন্তু আমার সামনে যে আমার ছেলেকে নিয়েই জটলা, তা বুঝতেই পারি নাই।
“সৈকতকে খুঁজতে আমি আবার দোকানের সামনে যাই। এর মধ্যে ওর আব্বুকে পাড়ার এক ছেলে ফোন করে জানায়, ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে। তখন তার আব্বু আমাকে জানায়।”
একমাত্র ছেলেকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই আফরোজা রহমানের। বলেন, “ছেলে আমার দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিল। খুব বাধ্য ছিল সে। তার এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আরেক বোন চাকরি করে। বাইরেই বেশি থাকে এই বোন। আমার ছেলে ঘরে থাকলে আমার কোনও চিন্তা থাকত না। ঘরের সব কাজে আমাকে সাহায্য করত সে।
“গণ্ডগোল শুরুর পর থেকেই তো ঘরে বুয়া আসতে পারে না। তাতে আমার কোনও সমস্যা হয় নাই। খাওয়ার জন্য ডাকত না আমার ছেলে। নিজে নিজেই সব করত। আমার সোনার ছেলেটা কই গেল?” বলতে বলতে ওড়নায় চোখ মোছেন আফরোজা।
তিনি বলেন, “বাইরের খাবার একদম খেতে চাইত না আমার ছেলে। আমার রান্না ছাড়া হাজার টাকার দামের খাবারও তার ভালো লাগত না। সবসময় যাই খেত, খেয়ে আমার ওড়নায় মুখ মুছত। সেদিনও (১৯ জুলাই) তাই করেছিল।
“একটা বিড়াল পালত সে। সেই বিড়ালও এখন আর ঘরের ভেতরে দৌড়ায় না। কোনও শব্দ করে না।”
সৈকতের মা জানান, দেশ নিয়ে কিছুদিন ধরে বিরক্ত ছিল তার ছেলে। খেতে চাইত না। খেতে বললেই বলত, ‘খাবো না, দেশে কী যে চলতেছে…”
এ বছরই প্রথম ভোট দেয় সৈকত। এ নিয়ে তার আক্ষেপও ছিল, জানালেন তার মা।
আফরোজা রহমান বলেন, “ছেলে একদিন বলে, ‘কেন যে হাসিনা সরকারকে ভোট দিলাম! ছেলেগুলোকে কীভাবে মারতেছে! কীভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছে!’”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমার ছেলেটা নাই হয়ে গেল। একমাস হয়ে গেল ছেলে ছাড়া আমরা ঘুমাই, খাই। আর আসবে না আমার ছেলেটা। আর আমার ওড়নায় মুখ মুছবে না।”
আফরোজা রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘরে ঢোকেন সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী।
ছোট ভাইয়ের স্মরণে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠান থেকে মাত্র ফিরেছেন তিনি। জানালেন, তার থেকে তিন বছরের ছোট সৈকত। দুই বোনের মধ্যে তার সঙ্গেই সৈকতের সখ্যতা ছিল বেশি।
সেবন্তী বলেন, “আমরা দুই বোন ছোট ভাইকে পাখির মতো আগলে রেখে বড় করেছি। আমরা ওর প্রতি ‘অবসেসড’ ছিলাম।
“আম্মু সেদিন যখন ভাইকে ফোনে পাচ্ছিল না, তখন আমি অফিসের কাজে বাইরে ছিলাম। আম্মুকে ফোনে বলেছিলাম, ‘ও যেমন ছেলে, দুইটা লাঠির বাড়ি খেলেই ঘরে চলে আসবে। তুমি একদম চিন্তা করো না।’”
সৈকতের মৃত্যুর পর হাতে আসা ভিডিওতে তাকে মিছিলের সবার সামনে দেখা গেছে জানিয়ে সেবন্তী বলেন, “মিছিলের একেবারে সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার ভাইটা কীভাবে পেল, জানি না। সবার সামনে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভেতরের এত সাহসের কথা জানলাম সে চলে যাবার পর।”
সৈকতের পরনের কাপড়গুলো সযত্নে রেখে দিয়েছেন তার মা। সেগুলো হাতে নিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে বলেছিলাম, আমরা বিচার চাই না। কার কাছে বিচার চাইব? বিচার চাওয়ার মতো মানুষ তো ছিল না।
“এখন সময় বদলেছে। এখন আমার রাজপুত্রের হত্যার বিচার চাই। এত মায়ের কান্না, এত মায়ের বুক খালি হয়েছে-তাদের আর্তচিৎকার বিফলে যেতে পারে না।”