ঈদের নামাজে যেতে হবে, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলে তানজিম হাসান সাকিবের নেওয়া সবগুলো উইকেট দেখা হয়নি বাবা মোহাম্মদ গৌছ আলীর। স্বাভাবিকভাবেই নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের পুরো খেলাটাও দেখতে পারেননি। তবে মসজিদে থাকতেই জেনেছেন ছেলে চার উইকেট নিয়েছে। সাকিবের মা সেলিনা পারভীন টিভি সেটের সামনেই বসেছিলেন। একেবারে নাওয়া-খাওয়া ভুলে। সাকিবের জন্য প্রতি ম্যাচে মায়ের অবস্থা এরকমই হয়। সঙ্গে থাকে বাবা-মায় দুজনের অশেষ দোয়া।
সাকিবের ক্রিকেট সংগ্রামের শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। বাংলাদেশের আর সব ঘরের মতো সাকিবের পরিবারও চেয়েছিল ছেলে পড়ালেখা করবে। সরকারি চাকরি পাবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারি চাকরির সেই আশাতেই সাকিবকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়েছিলেন বাবা গৌছ আলী। একমাত্র ছেলের একটা গতি হয়েছে বলে নিশ্চিন্তও হয়েছিলেন। সেই গতিটা যে সরকারি চাকরির চেয়েও বড় ও বিশেষ কিছু হয়েছে তা এখন একবাক্যে স্বীকার করলেন। সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে আলাপে ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার পেছনের গল্প জানিয়েছেন সাকিবের বাবা।
সাকিবের বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ যখন তৈরি হয়, একটু দ্বিধায় ছিলেন তিনি। মৌলভীবাজারের এক কোচের কথায় দ্বিধা কাটে তার। সরকারি চাকরির নিশ্চয়তার দারুণ গল্পটা শোনালেন এভাবে, “ওই সময় স্থানীয় একজন কোচ ছিলেন মৌলভীবাজারের। তার নাম খুব সম্ভব আবদুল জব্বার। সে বলল, আপনি ওকে (সাকিবকে) বাধা দিয়েন না। যদি সে এখানে ক্রিকেটার নাও হতে পারে, বেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপন করবে। আর এখান থেকে যে সার্টিফিকেট সে পাবে ওটা দিয়ে যে কোনও সরকারি চাকরিতে সে অগ্রাধিকার পাবে। তার ওই একটা কথা শোনার পর আমি আর পিছুটান দেইনি। বলেছিলাম যেভাবে হোক তাকে (সাকিবকে) ভর্তিতে সহযোগিতা কর।”
বিকেএসপির টিকেট পাওয়ার শুরুটা সাকিবের জন্য সহজ ছিল না। বাবা আর মায়ের বকুনি খেয়েও এগিয়ে গেছেন ছোট্ট সাকিব। এক সময় ছেলের একাগ্রতার কাছে হার মানেন তারা। সাকিব তখন সিলেটের বালাগঞ্জের সরকারি ডিএন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। মৌলভীবাজারে একটি ক্রিকেট ক্যাম্পে ৫০-৬০ জনের মধ্যে সেরা তিনে থেকে পেয়ে যান চট্টগ্রামের আরেকটি ক্যাম্পের ডাক। সেখান থেকে বিকেএসপিতে যাওয়ার সুযোগ।
অথচ এই সাকিবের জন্য ক্রিকেট খেলার সময় বেঁধে দেওয়া ছিল বিকালের দেড় ঘণ্টা। সাকিবের বাবা বলছিলেন, “আমিও ছেলের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। তার মা সবসময়ই আমাকে অভিযোগ করত যে ছেলে শুধু খেলার মধ্যে পড়ে থাকে, পড়াশোনায় মনোযোগী না। তো আমি তখন কাতারে ছিলাম। আমাকে ফোন দিলে আমি বলতাম যে তাকে শুধু আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত খেলতে দিও, কারণ খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”
খেলার প্রতি অতি আগ্রহের কারণে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যান গৌছ আলী, “মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সে খেলতে যেত, যেটা আমাদের জন্য বিরক্তির ছিল। কারণ আমার এক ছেলে। আমি চাইতাম সে ভালোভাবে পড়ালেখা করুক। জীবনে ভালো চাকরি পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু তার যে অদম্য ইচ্ছা বা আগ্রহ যে ক্রিকেটারই হবে সেই ইচ্ছার কাছে আমরা মাথা নত করেছি।”
ছেলের ইচ্ছায় সায় দিয়ে ভুল করেননি। তা বুঝেছেন যখন সাকিব ২০২০ সালে যুব বিশ্বকাপ জিতে বাড়ি ফিরল। সিলেট বিমানবন্দর থেকে ছেলেকে বরণ করে নিতে সিলেটের সাধারণ জনগণের স্রোত মুগ্ধ করেছে গৌছ আলীকে। পরে তার বাড়ির সামনে হাজার-হাজার মানুষের ভিড় বাবা হিসেবে মাথা উঁচু করেছে তার।
২০২০ সালের সেই মুহূর্তের স্মরণ করে গৌছ আলী বলেছেন, “অবশ্যই সে তার চেষ্টায় সফল হয়েছে। আমরা বাবা-মা তার এই অর্জনে খুবই খুশি। এখন মনে করি তার অদম্য ইচ্ছাই সঠিক ছিল। বিশেষ করে সে যখন যুব বিশ্বকাপ জিতে আসে। তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মানুষ যেভাবে হইহুল্লোড় করেছে সেই স্মৃতিটা আমার মনে পড়ে। আমার বাড়ির সামনে তখন কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়। সিলেট বিমানবন্দর থেকে তখনকার এমপি সাকিবকে গাড়িতে পাশে বসিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। সাথে কত মানুষ, মোটরসাইকেল! তখন মনে হয়েছে যে আমার ছেলের ইচ্ছায় সায় দিয়ে আমরা সার্থক।”
সাকিবরা চার ভাই বোন। সবার ছোট ও একমাত্র ছেলে এখন পরিবারের গৌরব। বড় দুই বোন লন্ডনে থাকেন, তৃতীয় বোন অনার্সে পড়ছেন সিলেটেই। পুরো পরিবারের কাছে সাকিবের খেলা এখন কাজের মধ্যে সবচেয়ে আগে। যে যেখানেই থাকেন খেলা দেখেন।
সঙ্গে সাকিব ও দেশের জন্য থাকে জয়ের দোয়া। আশ্চর্যজনকভাবে সাকিবের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের জয়ের পাল্লাটা ভারি। এখন পর্যন্ত ‘লাকি’ সাকিবের খেলা ১০ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ জিতেছে ৭ ম্যাচ। দুটিতে হার আর একটি ছিল পরিত্যক্ত। আর ওয়ানডেতে সাকিবের খেলা ৭ ম্যাচের মধ্যে ৫টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। হার একটি ও পরিত্যক্ত হয়েছে এক ম্যাচ।
ঈদের দিন দেশকে ডাবল খুশি উপহার দিয়েছেন সাকিব। তার পারফরম্যান্সে প্রথমবার বিশ্বকাপে তিন ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। ২০০৭ এরপর দ্বিতীয়বার উঠেছে সুপার এইটে। সাকিবের বাবার ইচ্ছা যুব বিশ্বকাপের মতো ছেলের পারফরম্যান্সে এবারও বিশ্বকাপ জিতে ফিরুক ক্রিকেট দল।