Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

তাজরীনে অগ্নিকাণ্ড : সাক্ষী আসছে না, মামলা এগোচ্ছে না

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের জন্য মালিকদের দায়ী করে শ্রমিকরা নানা কর্মসূচি পালন করেন।
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের জন্য মালিকদের দায়ী করে শ্রমিকরা নানা কর্মসূচি পালন করেন।
[publishpress_authors_box]

সাক্ষী মোট ১০৪ জন, কিন্তু ১২ বছরে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে মাত্র ১৫ জনের। সাক্ষী না আসায় এগোচ্ছে না বিচারকাজ; ফলে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের শাস্তিও হচ্ছে না।

এদিকে বিচারের আশায় থাকতে থাকতে হতাশ এখন এই পোশাক কারখানার আহত শ্রমিকরা। অঙ্গ হারিয়ে অনেকে হারিয়েছেন আয়ের পথ। তাই ক্ষতিপূরণ চাইছেন তারা।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে মারা যায় ১১১ শ্রমিক, আহত হয় অনেকে। আহতদের মধ্যে আরও কয়েকজন পরে মারা যায়।

তার পাঁচ মাসের মাথায় সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক মারা গেলে দুটি ঘটনা মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অনিরাপদ পরিবেশ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকরা বিদেশি ক্রেতাদের সহযোগিতায় কারখানায় কর্মপরিবেশ উন্নত করতে নানা পদক্ষেপ নিলেও তাজরীনের শ্রমিকরা বিচার পাননি এখনও।

তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা দায়ের করেন। এক বছর বাদে ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামান খান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

তাতে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।

২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হলেও তা চলছে শম্বুক গতিতে।

মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নাসরিন জাহানের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর ষোড়শ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারিত ছিল। তবে সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আদালত শুনানি ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেন।

ওই আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) মো. রবিউল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে জানান, তিনি যোগদানের পর এই মামলায় শুনানির এই দিনটিই পেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন কোনও সাক্ষী আসেনি।

রাষ্ট্র ও আসামি দুই পক্ষের আইনজীবীরাই বলছেন, সাক্ষীরা আদালতে না আসায় বিচার শেষ হতে দেরি হচ্ছে।

সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। সেই দায়িত্বে থাকা আইনজীবীরা বলছে, এই মামলার সাক্ষীরা অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক। তাদের চাকরি ও বাসস্থানের ঠিকানা বার বার বদল হয়। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বার বার সমন দিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত করেন এপিপি রবিউল। তিনি বলেন, “যারা গার্মেন্টস শ্রমিক, তারা একদিন অনুপস্থিত থাকলে তাদের বেতন আটকে দেওয়া হয়। নিয়মিত তারিখের মধ্যে তাদের বেতন হয় না। অপেক্ষায় থাকতে হয় আরেক মাসের জন্য। এই পরিস্থিতিতে আদালতে সাক্ষী দিতে আসাটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়, তাদের কাছে মুখ্য বিষয়টি হচ্ছে প্রতিদিন গার্মেন্টসে উপস্থিত থাকা। এসব কারণেই অনেকে সমন পেয়েও আদালত উপস্থিত হচ্ছেন না।”

অগ্নিকাণ্ডের পর তাজরীন ফ্যশনস কারখানা।

মামলার প্রধান আসামি তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ারের আইনজীবী হেলেনা পারভীনও জানান, বিচার দ্রুত শেষ হোক, তা তারাও চান। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না বলে বিচার ঝুলে আছে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ ঠিকমতো সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছে না। এজন্য সাক্ষ্যগ্রহণও শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিরা মানসিক ও আর্থিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে।”

সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন পোশাক শ্রমিক আন্দোলনের নেতা, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত একযুগ ধরে আমরা তাজরীন মামলাটির কার্যক্রমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রত্যেকটি সাক্ষ্য শুনানিতে উপস্থিত থেকেছি।

“বছরের পর বছর আদালতে আসা-যাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা মনে করি, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার পেছনে মামলাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের দায়সারাপনা দায়ী। আমরা তিল তিল করে প্রত্যক্ষ করেছি যে,  বিচারকার্য পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের এই ব্যবস্থাগত অবহেলা, ঔদাসীন্য মালিকের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।”

তবে নতুন এপিপি রবিউল আশ্বাস দিচ্ছেন, সাক্ষী হাজিরে তৎপর হবেন তারা।

তিনি বলেন, “আমরা সাক্ষীদের ট্রেস করতে পারলে অবশ্যই গার্মেন্টস মালিকদের নোটিস পাঠাব। রাষ্ট্রীয় খরচে সাক্ষীদের আদালতে আনার ব্যবস্থাও করতাম। কিন্তু আমরা তাদের ঠিকানায় খুঁজে পাচ্ছি না।

“তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, সাক্ষ্য হাজির করে খুব শিগগিরই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।”

দুর্ঘটনা, না হত্যা

তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন।
তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন।

অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে চিহ্নিত করে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তাজরীন ফ্যাশনস ভবনের নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। ফলে একসঙ্গে এত শ্রমিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।

তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করছেন, এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র।

আসামি দেলোয়ারের আইনজীবী পারভীন বলেন, “মামলার তদন্ত প্রতিবেদনেই এসেছে, এটা একটি নিছক দুর্ঘটনা মাত্র। কেউ কি আর ইচ্ছে করে ২৫০/৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করবে।”

আসামি পক্ষের আরেক আইনজীবী রোকেয়া বেগম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষী আদালতে ভুল সাক্ষ্য দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনও সঠিক না।

“আসামিরা চাকরি ফেলে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটার সত্যতা নেই। আইনগত দিক বিবেচনা করে মামলা নিষ্পত্তি হলে তারা নির্দ্বিধায় খালাস পাবেন।”

তার জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রবিউল বলেন, “তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানুষের সৃষ্টি, প্রাকৃতিক সৃষ্টি নয়। নিরীহ ১১৩ জন শ্রমিকের প্রাণের মূল্য তাদের দিতে হবে। এই মামলায় জড়িত সকল আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ কাজ করে যাবে।”

মামলায় আসামিরা হলেন- তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল।

আসামিদের মধ্যে আল আমিন, রানা, শামীম, ও মোবারক হোসেন পলাতক রয়েছেন। দেলোয়ারসহ বাকি সব আসামি জামিনে মুক্ত।  কয়েক বছর আগে দেলোয়ার তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি সহযোগী সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার নেতাও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

প্রতি বছর ২৪ নভেম্বর তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো।

‘মরে গেলেই ভালো হতো’

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে আহত অনেকে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সেই যাতনার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচার না পাওয়ার হতাশা।

জরিনা খাতুন নামে এক শ্রমিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১২ বছর হয়ে গেল, বিচার পেলাম না। আমাদের পুনর্বাসনও হলো না। দুই বাচ্চা আর মাকে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। কোথাও গিয়ে দাঁড়াবো, সেই জায়গাটুকুও নেই। আমরা তাদের বিচার চাই, পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও চাই।”

সেদিন অনেক সহকর্মীকে হারাতে হলেও ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন জরিনা। তবে এখন করছেন আক্ষেপ।

“গেটম্যান আল-আমিন গেটে তালা লাগিয়ে দিল। অনেকে বিল্ডিং থেকে লাফ দেয়। সেদিন কেন লাফ দিয়েছিলাম জানেন? বাঁচার আশায় না। আগুনে পুড়ে মরলে পরিবার লাশটা পেত না। লাফ দিয়ে পড়ে পরে পরিবার অন্তত লাশটা তো পাবে। এ ভেবে লাফিয়ে পড়ি। লাফ দিয়ে এমন বাচাঁই বাঁচলাম, সবার কাছে বোঝা হয়ে গেছি। এখন মনে হয়, সেদিন আগুনে পুড়ে মরে গেলেও ভালো হত।”

জরিনার মতোই পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা রেহানা বেগম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কী যে কষ্টে আছি, বলার ভাষা নেই। দুই বেলা দুই মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারি না। জমি যা ছিল, তা বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি। এখন আমরা ক্ষতিপূরণ চাই। সেটা এমনভাবে দেওয়া হোক, যেন কারও রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে না হয়।”

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন বলে জানান রেহানা, এখন দেখতে চান সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন।

“তার কাছে আমাদের অনুরোধ, তিনি বিষয়টা যেন শেষ করেন। আমরা ধুকে ধুকে মরতে চাই না, বাঁচতে চাই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত