উড়োজাহাজের ককপিট। সেখান থেকে প্রধান পাইলট হ্যান্ড মাইকে যাত্রীদের উদ্দেশে বলছেন, আজকের দিনটা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ এমন একজন তার উড়োজাহাজে চড়ে যাচ্ছেন, যার কারণেই তিনি আজ বিমান চালানোর হাল ধরেছেন। তিনি তার স্কুলশিক্ষক।
ছাত্র যখন এ কথা বলছিলেন, সেই শিক্ষক তখন চোখের জল মুছছিলেন। সে সময়ে কয়েকজন কেবিন ক্রু ফুলের তোড়া হাতে এগিয়ে এসে তার হাতে তুলে দেন। এসময় বিমানের সব যাত্রী হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান শিক্ষক-ছাত্র দুজনকে। টার্কিশ এয়ারলাইন্সের কয়েক বছর আগের এ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হয় লাখ লাখ।
নতুন করে সেই ভিডিও বাংলাদেশিরা শেয়ার করছেন গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের নাজেহাল হওয়ার নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজে এ চিত্র দেখা গেছে। গত প্রায় এক মাসে এটি নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে।
ভিডিওগুলোয় দেখা গেছে, শিক্ষককে ঘিরে চিৎকার করছে শিক্ষার্থীরা। নানা ধরনের স্লোগানও দিচ্ছে। একপর্যায়ে শিক্ষককে পদত্যাগপত্র ধরিয়ে দিয়ে তাতে সই করাতে বাধ্য করছে।
বিষয়টি নিয়ে নতুন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বারবার সতর্ক করেছেন। সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও কথা বলছেন।
তবে তাদের এসব বক্তব্যের পরও শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি এখনও। মঙ্গলবারও রাজধানী ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানেও এমন ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবখানে ব্যাপক দলীয়করণের অভিযোগ ছিল। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকদের ‘ফ্যাসিবাদের’ সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত করে তা তাদের ওপর চড়াও হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হচ্ছে।
তবে যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ায় আসলেই পদত্যাগ হয় কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
আর এই ঘটনাগুলো দেশের ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘সই দিয়ে পদত্যাগ করে পরিস্থিতি সামলেছি’
ঢাকার মিরপুরের সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ডা. অসীম দত্ত। মঙ্গলবার সকালে তিনি তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নিচ্ছিলেন। সে সময় তারই সাবেক ছাত্রদের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি দল ক্লাসে ঢোকে।
তাকে বলা হয়, তিনি ছাত্রলীগকর্মী ছিলেন। সরকার পতনের আগে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছেন। তাই তার চাকরি করার অধিকার নেই, নৈতিকতাও নেই।
পদত্যাগপত্রে সই করতে না চাইলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন এই শিক্ষক।
ডা. অসীম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাকে আড়াই ঘণ্টার মতো ঘিরে ধরে আটকে রাখা হয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। ক্লাসের মধ্যে আমার শিক্ষার্থীরা ছিল, কী এক ভীতিকর পরিবেশ! আমাকে বলা হয়- আমি বাংলাদেশের বিরোধিতা করে অখণ্ড ভারত চেয়েছি, আমি ইসকনের সদস্য।
“আড়াই ঘণ্টা আটকে রেখে প্রথমে আমাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। আমি রাজি হইনি বলে পরে ওরাই একটা কাগজে লিখে নিয়ে এসে আমাকে স্বাক্ষর করতে বলে। স্বাক্ষর করতে না চাইলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। পদত্যাগপত্রে সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় চাকুরী হইতে ইস্তফা দিলাম লেখা হয়।”
বাধ্য হয়ে পরে ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন তিনি; তবে সেই চিঠিতে তার নামের বানানটিও ছিল ভুল।
ডা. অসীম বলেন, “এভাবে পদত্যাগ করানো যায় না, এটা প্রসিডিউর না। সরকারি চাকরিতে বললেই কেউ কাউকে এভাবে পদত্যাগ করাতে পারে না।
“কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে ওই মুহূর্তে এছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। তখন আমার ক্লাসের ছাত্ররা সামনে বসে কাঁপছিল। আমার জন্য এটা তো কোনও সুখকর পরিস্থিতি না। তাই সই দিয়ে পদত্যাগ করে পরিস্থিতি সামলিয়েছি।”
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন আনোয়ার হাবিব। ২৮ আগস্ট তার পদত্যাগের খবর পাওয়া যায়। তবে তার পদত্যাগও স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন সকালে আনোয়ার হাবিব তার অফিসেই ছিলেন। ৪০ জনের মতো একটি দল তার কক্ষে ঢোকে। তাদের সঙ্গে থাকা পদত্যাগপত্রে তাকে দিয়ে জোর করে স্বাক্ষর করায়। স্বাক্ষর করার পর তিনি বাসায় চলে যান।
গত ২২ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শফিকুল আলম চৌধুরী ও উপাধ্যক্ষ ডা. দেবেশ চন্দ্র তালুকদারের পদত্যাগ করার খবরও আসে। তাদেরকেও বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় এই মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদত্যাগের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন।
সেখানে দেখা যায়, অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে আছেন অধ্যাপক ডা. শফিকুল আলম চৌধুরী। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন উপাধ্যক্ষ ডা. দেবেশ চন্দ্র তালুকদার। তাদের ঘিরে ধরে চিৎকার করছিল শিক্ষার্থীরা। নানা ধরনের হুমকি দিয়ে পদত্যাগ করতে বলছিল তারা।
এক শিক্ষকের পদত্যাগপত্রে লেখা হয়েছে, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরাসরিভাবে অবস্থান করে ছাত্র–জনতার কাছে নিজের আস্থা হারিয়ে আমি আমার অধ্যক্ষ পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি।”
আরেক শিক্ষকের পদত্যাগপত্রেও ছিল একই ধরনের লেখা।
‘পরদিন এটা ওরা করবে-স্বপ্নেও ভাবিনি’
ঢাকা মেডিকেলের এই অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের মধ্যে একজন সকাল সন্ধ্যার কাছে সেদিনের ঘটনা তুলে ধরেন।
চরম হতাশা নিয়ে ওই শিক্ষক বলেন, “এই ছাত্ররা আমাদের ছাত্র। ওদের সুখে-দুঃখে দিন রাত কথা বলেছি। হলগুলোতে দিন-রাতের যেকোনও সময় ছুটে গিয়েছি। পদত্যাগের আগের দিনও তাদের সঙ্গে বসেছি, নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু পরদিন এটা ওরা করবে- স্বপ্নেও ভাবিনি।
“সেদিন কক্ষে ঢুকেই তারা প্রশ্ন করতে থাকে- আমরা কেন আন্দোলনে যাইনি? চিকিৎসকদের করা শহীদ মিনারে শান্তি মিছিলে গিয়েছি, কেন গিয়েছি? ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে কেন কথা বলেছি। উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের এসব প্রশ্নে আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম- সরকারি চাকরি করি, চাইলেও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না। শান্তি মিছিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের যেতে হয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা কেউই আমাদের কথা শোনার মতো অবস্থায় ছিল না; অথবা শুনতে চাচ্ছিল না।”
শিক্ষকদের প্রতি সম্মান-ভালোবাসা-ভক্তির প্রসঙ্গ টেনে এই শিক্ষক বলেন, “আমরা এখনও গ্রামে গেলে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। আর এ কোন যুগে এলাম আমরা? এটা কি মধ্যযুগ চলছে? বিষয়টা তো হিরোইজমের পর্যায়ে চলে গেছে।”
“সারাদেশে এগুলো কী করছে ছেলে-মেয়েরা? কেউ ওদের থামাচ্ছে না কেন”- বলেন এই শিক্ষক।
টার্গেট হিন্দু শিক্ষকরা?
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ বলছে, সরকার পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব শিক্ষক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই হিন্দু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরিদপুরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বয়স্ক এক শিক্ষকও একই অভিযোগ করেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় ভয়ের মধ্যে আছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার দিন সারাদেশে দলটির কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িঘর আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হয়। তার প্রতিবাদও হয়েছিল।
ফরিদপুরের ওই শিক্ষক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আর কয়দিন পর অবসরে যাব। কিন্তু আমার তো আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে। চোখের সামনে এগুলো নিতে পারছি না। তার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো।”
আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, “ওদের তো সন্তানের মতো দেখেছি, জেনেছি। পরীক্ষার আগে আগে বাড়ি বাড়ি গিয়েছি, সাহস দিয়েছি; শাসনও করেছি। কাদের জন্য এসব করেছি “
চতুর্দশ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা শুক্লা রানী হালদার ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। তার আগে তিনি ছিলেন বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।
অভিযোগ রয়েছে, গত ২৯ আগস্ট দুপুরে বহিরাগতসহ কলেজের শিক্ষার্থীরা তাকে তার কার্যালয়ে প্রায় চারঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। বাধ্য করে পদত্যাগ করতে। সেই অবরুদ্ধ অবস্থার ছবি ছড়িয়ে পড়ে ফেইসবুকে।
নিঃসন্তান এই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী।
তার এক আত্মীয় সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পপুলার শিক্ষক ছিলেন তিনি। এই বয়সে শিক্ষার্থীসহ অন্যদের হাতে এভাবে নাজেহাল হওয়াতে তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। পরিবারের কারও সঙ্গেও সেভাবে কথা বলছেন না। আমরাও এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছি না। সময় যাক, তিনিই কথা বলবেন।”
তাকে নাজেহালে কারা ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যতটুকু শুনেছি, সেদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাইরের মানুষ বেশি ছিল। তাদের মধ্যে বিএনপির মানুষ ছিল। তারা দিদির (শুক্লা রানী হালদার) কলেজে অনুপস্থিতিসহ বেশকিছু অনিয়ম নিয়ে কথা বলে তার পদত্যাগ চান। একসময় তার কক্ষের ভেতরে ঢুকে সাদা কাগজে পদত্যাগ করলাম লিখতে বাধ্য করেন।”
বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ গত ৩১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, সরকার পতনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯ শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে স্বপদে বহাল করা সম্ভব হয়েছে।
‘ট্রমা থাকবে দীর্ঘদিন’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষক-চিকিৎসকদের হেনস্তার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে করে এই মানুষগুলোর ট্রমা থাকবে দীর্ঘদিন। সঠিক ব্যবস্থা না নিলে অনেকেই ‘এই আঘাত’ থেকে বের হতে পারবেন না।
তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সে অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে, শিক্ষার্থীরা না।
মব জাস্টিস নামে যা হচ্ছে, সেটা কাম্য নয় মন্তব্য করে এই চিকিৎসক বলেন, “এসব পদত্যাগ নিয়ে সরকার থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। কারণ যে প্রক্রিয়ায় তারা পদত্যাগ করছেন, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।”
‘ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেত’
বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের এখনকার চিত্র ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। তবে তিনি একই সঙ্গে বলেন, এই অবস্থা ‘হুট করে হয়নি’। উচ্চশিক্ষা শেষে ২০২১ সালে দেশে ফিরে ফেরার পর চেনা চিত্র বদলে যেতে দেখেছেন এই শিক্ষক।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তখন থেকেই ধীরে ধীরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে সেই চিরচেনা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের অভাব অনুভব করছিলাম। এটা হঠাৎ করে হয়নি, গত কয়েক বছর ধরেই এটা ধীরে ধীরে বাসা বেঁধেছে।
“শিক্ষার্থীদের মনটা বদলে গেছে, বদলেছে শিক্ষকদের মনটাও। শিক্ষার্থীদের ধৈর্য নেই, স্থিরতা নেই। তারা ইমপালসিভ, রিঅ্যাকটিভ, ম্যানারলেস, রাফ অ্যাটিচিউড। এরা ভীষণভাবে পরিবর্তিত, এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জেনারেশন।”
এসবের পেছনের কারণও খুঁজেছেন নৃবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। বিশ্বকে বদলে দেওয়া কোভিড মহামারী এর কারণ হিসাবে পেয়েছেন তিনি।
স্নিগ্ধা বলেন, “দীর্ঘ একটা সময় সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, অটো পাস; সঙ্গে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থিয়েটার, আবৃত্তি, পথনাটকের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিলীন হয়ে যাওয়া, খেলার মাঠ না থাকা, ডিভাইস আসক্তি এর অন্যতম কারণ।”
এসময় ‘শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তি, অধঃপতন, কতিপয় শিক্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়কে হাতিয়ার করে ক্ষমতাসীন সরকারের চাটুকর হয়ে যাওয়ার’ কথাও বলেন তিনি।
“শিক্ষকদের সম্মান আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এসব কারণেই”, বলেন এই শিক্ষক।
দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ায় ‘আসলেই পদত্যাগ হয় কি না’ সে প্রশ্ন স্নিগ্ধাও তুলেছেন।
“এটা মব জাস্টিস। আর মব জাস্টিস তো এখন পলিটিসাইজ। আর এটাই বর্তমান প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর অতি সত্ত্বর সমাধান হওয়া উচিত।”
শিক্ষকদের অপমান করাটা সারাদেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে মনে করছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এখন গ্রামের সাধারণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককেও পদত্যাগ করতে হবে। অনেক ঘটনাতেই শিক্ষার্থীদের কথা শুনে বুঝতে পারছি এই দাবির সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা রাজনৈতিক নিয়োগ প্রাপ্ত এবং তারাসহ তাদের সঙ্গীরা সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করবেন এটা রীতি।
“কিন্তু এখন কলেজ, স্কুল, নার্সিং ইন্সটিটিউট কিছুই বাদ যাচ্ছে না। দুর্নীতি থাকলে তদন্ত হোক, অদক্ষ হলে সেটার জন্য কারণ দর্শানো হোক। কিন্তু ২০/৩০ জন গিয়ে শিক্ষকের রুমে ঢুকে গায়ের জোরে পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করানো কোন ধরনের আচার।”
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের হেনস্তা না করার আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
গত ২৩ আগস্ট শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বিবৃতি দিয়ে আহ্বান জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৬ বছরে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, সবকিছুর আগে তাদের দলীয় পরিচয় ও আনুগত্য বিবেচনা করা হয়েছে।
শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে, শিক্ষার্থীদের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ বা অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে নিরসনের কোনও উপায় না থাকায় অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
জোরপূর্বক পদত্যাগ গ্রহণযোগ্য নয় : শিক্ষা উপদেষ্টা
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিবৃতি দেওয়ার আগের দিন গত ২২ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কথা বলেন।
সচিবালয়ে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গনে বল প্রয়োগ করা যাবে না এবং কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না। যে যত অন্যায় করুক না কেন, নিয়মমাফিক যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
মঙ্গলবারও শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে পুনরায় এ আহ্বান জানান তিনি।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, এখনও শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও নানাভাবে হেনস্থা করার ঘটনা ঘটছে; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগ আছে তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’তে এভাবে হেনস্তা করার বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
তাতে বলা হয়, ‘কর্তৃত্ববাদী’ আওয়ামী লীগের দেশ শাসনে জমে থাকা ক্ষোভ এবং আন্দোলন দমনে গুলিতে কয়েকশ মানুষের মৃত্যুতে মানুষের ক্রোধ থাকাটা অস্বাভাবিক না হলেও অতি উৎসাহী এবং স্বার্থান্বেষী মহলের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনায় সরকার উদ্বিগ্ন।
এরপরও এই ধরনের কর্মকাণ্ড যারা চালাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে।