আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থনকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক নেটওয়ার্ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ কী হতে পারে, তার একটি সুপারিশ দিয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার বিদায়ের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দুই দিন বাদে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়।
শিক্ষক নেটওয়ার্ক স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ৬টি কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে ১৩টি বিষয়ের ওপর গুরুত্বআরোপ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ বিভাগের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কী চাই’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
১০ বছর আগে গঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগেই তার পদত্যাগের পর গণতান্ত্রিক রূণান্তরের একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিল।
সেই বৈঠকে শারমিন এস মুরশিদও ছিলেন, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন।
আশু করণীয়
১. জনগণের জান-মালের সুরক্ষায় অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামতে হবে ও সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের জন্য সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পস্থাপনা, উপাসনালয়, মাজার, ভাস্কর্যের উপর হামলা ঠেকাতে হবে ও হামলার বিচার করতে হবে।
৩. জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং জনগণের ওপর নৃশংস জোর-জুলুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় তদন্ত কমিটি এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত তদন্ত ও বিচার কাজ শুরু করতে হবে।
৪. কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে সাবলম্বী করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. সাম্প্রতিক সময়ে করা মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক ও হয়রানিমূলক মামলা বাতিল করতে হবে এবং এসব মামলায় আটক সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।
৬. অর্থনীতির চাকা সচল করতে শিল্প-কলকারখানা খুলে দিয়ে সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদে করণীয়
সরকারি উদ্যোগে কমিউনিটি সেন্টার : পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ দখল বন্ধ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে কমিউনিটি সেন্টার চালু করতে হবে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধসহ মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়সহ জুলাই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের তালিকা, স্মৃতিস্তম্ভ এবং ছবি থাকবে। প্রতি বছর জুলাই মাসে যেন সারাদেশ জুড়ে তাদের স্মরণ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল : সংবাদমাধ্যমকে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। জনগণের মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রথমেই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। এই আইনে বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক সকল নিরপরাধ ব্যাক্তিকে মুক্তি দিতে হবে।
বাজারের সিন্ডিকেট বিলুপ্ত : পণ্যের বাজারে সব সিন্ডিকেট বিলুপ্ত করতে হবে। কৃষি খাতের বাজার ব্যবস্থাপনা পুনরুদ্ধার করতে হবে। কৃষিখাতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজের যে কোম্পানিকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, তা রোধ করার উপায় সন্ধান করতে হবে।রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্থানীয় ও অপরাপর বীজ সংরক্ষণ ও বীজ গবেষণা করবে। নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান করতে হবে সবার জন্য।
প্রশাসনিক সংস্কার : আমলাতন্ত্র সংস্কার করে জনবান্ধব প্রশাসনিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার ও পুনর্গঠন করতে হবে। বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করতে হবে। প্রশাসনিক কাঠামোকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়।জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে। ডিজিএফআই, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি বাহিনী কর্তৃক জনগণের ওপর নিপীড়ন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, তার দিক-নির্দেশনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিদেশি গোপন চুক্তি প্রকাশ : যত দেশি-বিদেশি গোপন চুক্তি আছে, সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।দুর্নীতিদমন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে যেন দুর্নীতিদমনের কাজট শুধু কতিপয় ব্যক্তিকে দায়বদ্ধ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।স্বৈরাচারী সরকারের সময় সংঘটিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার করতে হবে।পুরো প্রশাসনের ছায়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ইত্যাদি গঠন করতে হবে যাতে সামাজিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়।
শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রবাসী নিয়ে টাস্কফোর্স : শিক্ষা নীতি নিয়ে নতুন একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। বিদ্যমান শিক্ষাক্রম বাতিল, পুনর্বিন্যাস এবং যুগোপযোগী করা নিয়ে আলোচনা করতে হবে । নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ ও নতুন আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতেও এমন একটি নতুন টাস্কফোর্স গঠন করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের রূপকল্প করতে হবে। প্রবাসীদের কেবল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হিসেবে না দেখে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করার জন্য তাদের প্রাণ ও জীবনমানকে যথাযথ মূল্য দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
পাহাড়িদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে : পাহাড়িদের তাদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কী করা যায়, তা নিয়ে পাহাড়িদের সাথেঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সকল অসম প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে শিল্পে ভর্তুকি : বাংলাদেশের শিল্পের বিকাশ কেমন হবে, কোন শিল্পকে অগ্রধিকার দেওয়া হবে, কোন শিল্প ভর্তুকি দেওয়া হবে, এই প্রশ্নগুলো জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় ঠিক করতে হবে।
ব্যাংক ঋণ নিয়ে অনুসন্ধান : ব্যাংক থেকে ঋণগুলো কীসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, এবং তা কী কাজে লাগানো হচ্ছে-এ নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান জরুরি। এর ভিত্তিতে দুর্বৃত্ত চক্রকে এবং নিয়মভঙ্গ করে নেওয়া ঋণগ্রহীতাদের সামনে এনে উপযুক্ত বিচার করতে হবে।
নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ : সবার জন্য জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
‘সংবিধানের অধীনে যেই আসবে, স্বৈরতন্ত্র হবে’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয় গত অগাস্টের শুরুতেই। তাতে কয়েকদিনের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।
বিভিন্ন দল, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন স্তরের মানুষের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছিল শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
সেদিকটি তুলে ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “দুর্নীতি, লুন্ঠন, জুলুম, অত্যাচার এগুলো সম্পর্কে শ্বেতপত্র আমরা করতে পারব না। আমাদের কাছে তথ্য নেই। এইসব এই সরকারকেই করতে হবে।
“আপনারা একটা কথা শুনেছেন রাতারাতি কিছু করা সম্ভব না। রাতারাতি করতে বলে নাই। কাজটা শুরু করে দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই। দায়িত্ব পালনে যদি তারা অজুহাত তৈরি করে, সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকসহ ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই প্রক্রিয়া জারি রাখতে হবে।”
আনু মুহাম্মদ বলেন, “এই সংবিধানের অধীনে যে সরকারই আসবে, সে স্বৈরতন্ত্র হবে। কিছু গোষ্ঠী আছে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ভয়ংকর সময়ে আমরা সৃজনশীলতার সময় পার করেছি। গান, কবিতা, গ্রাফিতি হয়েছে। সেই সৃজনশীলতার মধ্যে আক্রমণ করেছে কিছু গোষ্ঠী, তাদেরকে চিন্হিত করতে হবে।”
বাগেরহাটে সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন থাকবে, এই প্রশ্নটা এসেছে আজ। আসলে প্রশ্নটা হলো তারা কী কী করবেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে তারা কী কী করবেন? তাদেরকে স্বচ্ছ হতে হবে। আমাদেরকে বলতে হবে। তারা বলতে গেলেই আমরা টাইম ফ্রেমটা বুঝব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘‘কেউ কেউ বলেছেন, ভিসির বাড়ি ছাত্রী হল করে দেওয়া উচিৎ। আমাদের যারা ভিসি হয়, ওই বাড়িটার প্রতি লোভ থাকে। এটা ব্রিটিশ শাসনের হেরিটেজ। ঔপনিবেশিক শাসনের স্মৃতিচিহ্নটাই জাদুঘর করে দেওয়া উচিৎ। আমরা স্বৈরাচারকে জাদুঘরে পাঠাতে চাই। একটা স্বৈরাচারী জাদুঘর করতে চাই।”