তরুণ নির্মাতাদের চলচ্চিত্র মুক্তির আগে অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ ও মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে অকাল প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের স্মৃতিবিজড়িত তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট (টিএমএমটি)।
এই উদ্যোগে তাদের সঙ্গে আরও আছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম প্রডিউসার্স প্ল্যাটফর্ম অব বাংলাদেশ (আইএফপিপিবি) এবং সিনে ক্র্যাফট।
‘তারেক মাসুদ টেকনিক্যাল শো’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠান হবে প্রতি পনের দিন পর পর অর্থ্যাৎ মাসে দু’বার।
শুক্রবার ছিল এ আয়োজনের দ্বিতীয় আসর। এতে চারজন নবীন নির্মাতার চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
আহসান সরনের ‘রেড অ্যাপল’, নাহিদ নোমানের ‘জয়েনিং লেটার’, ইউসুফ খান নুরের ‘উইন্ডো অফ দ্য সোল’ এবং অনন্ত কুমার দাশের ‘অঙ্গীকার’ প্রদর্শনের পর প্রতিটি চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।
আলোচনায় অংশ নেন চলচ্চিত্র সমালোচক সাদিয়া খালিদ রীতি, চলচ্চিত্রকার প্রসূন রহমান, চলচ্চিত্র শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ সাজ্জাদ হোসেন, সিনেমাটোগ্রাফার মোহাম্মাদ আরিফুজ্জামান, চলচ্চিত্রকার ও সম্পাদক শারমিন দোজা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক সাজেদুল ইসলাম এবং শব্দ সম্পাদক নাহিদ মাসুদ।
নবীন নির্মাতাদের চলচ্চিত্রের বিষয় বৈচিত্র্য এবং গল্প বলার ধরনে ‘নতুনত্ব’ পেয়ে সবাই প্রশংসা করেন।
পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, সেই বিষয়েও পরামর্শ দেন।
এ ধরনের আয়োজন নতুন নির্মাতাদের সামনের দিকে এগিয়ে নেবে বলে আশাবাদ জানান উপস্থিত নির্মাতা ও অতিথিরা।
এর আগে গত ৮ নভেম্বর শুক্রবার দেখানো হয়েছে মোমো রাখাইন তামুক্ষ্যাঁ নির্মিত ‘এ স্নেইল উইদাউট এ শেল’, খালেক সাদমান নির্মিত ‘সেনাপতি দীঘি’ এবং শুভাশীষ সিনহা ‘তিরাস’।
এই টেকনিক্যাল শো নিয়ে সকাল সন্ধ্যার কথা হয় তারেক মাসুদের অনুজ নাহিদ মাসুদের সঙ্গে।
তার প্রতিষ্ঠান সিনে ক্র্যাফট এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে।
নাহিদ মাসুদ বলেন, “তরুণ নির্মাতাদের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা যে ধরনের ছবিগুলো বানায় তারা দেখানোর জায়গা পায় না।
“কোন কোন জায়গায় তাদের নির্মাণে ত্রুটি আছে বা কোন কোন জায়গায় উন্নতি করা সম্ভব তা নিয়ে অভিজ্ঞদের মতামত পাচ্ছে তারা এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে। অভিজ্ঞরাও তরুণদের বৈচিত্রপূর্ণ কাজের সঙ্গে, তাদের গল্প বলার নতুন ভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এই মিথস্ক্রিয়াটা জরুরি।”
এই প্রকল্পে তরুণদের ভালো সাড়া মিলছে বলে জানালেন নাহিদ মাসুদ।
এখন পর্যন্ত প্রচুর চলচ্চিত্র জমা পড়ছে।
পরের আয়োজনে অংশ নিতে tmtechnicalshow@gmail.com ই-মেইলে বিস্তারিত পাঠাতে পারবেন নবীন নির্মাতারা।
তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে আর কী কী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে সামনে?
সকাল সন্ধ্যাকে এ নিয়ে নাহিদ বলেন, তারেক মাসুদের স্মৃতি ও কাজের সংরক্ষণ ও তরুণদের মাঝে তারেক মাসুদের ‘লিগ্যাসি’ ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিই করছে এ ট্রাস্ট।
তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছেন। তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র সংরক্ষণ, ৩৫ মিলিমিটারে নির্মিত চলচ্চিত্র আর্কাইভ করা, তারেক মাসুদকে নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাস্ট্রে। সেখানে ডিজিটাল আর্কাইভ ও ফিল্মমেকিংয়ের উপর শিক্ষকতা করছেন ইউনিভার্সিটি অব কাইনেকটিকাটে।
তারেক মাসুদের অসমাপ্ত নির্মাণ ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রটি অপেক্ষায় আছে ক্যাথরিনের; এই মন্তব্য করলেন নাহিদ মাসুদ।
তিনি বলেন, “ক্যাথরিন প্রায় বিশ বছর তার দেশ থেকে দূরে ছিলেন।
“সবকিছু গুছিয়ে তিনি যুক্তরাস্ট্রে গেছেন, সিনেমার উপর পড়াশোনা করেছেন, এখন শিক্ষকতা করছেন। এরমধ্যে একটি ডকুফিল্মও বানিয়েছেন ‘অ্যা ডাবল লাইফ’ নামে। আশা করি, ও ফিরলে ‘কাগজের ফুল’ তার হাত দিয়েই পরিণতি পাবে।”
নাহিদ বলেন, বেশ ক’বছর বিরতির পর আবারও তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র উৎসবটি চালু করার ইচ্ছা পোষণ করছেন তারা।
বরেণ্য নির্মাতা তারেক মাসুদ ছিলেন একজন বাংলাদেশি স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার।
২০০২ সালের ‘মাটির ময়না’ তার প্রথম ফিচার চলচ্চিত্র। এজন্য তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট এবং আরো অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন।
‘মাটির ময়না’ প্রথম বাংলাদেশি বাংলা চলচ্চিত্র যা সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশি নিবেদন ছিল।
তারেক মাসুদ পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো ১৯৮৫ সালের ‘সোনার বেড়ি’। তার সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২০১০ সালের ‘রানওয়ে’।
চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে।
২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান, প্যাসিফিক, আমেরিকান ইন্সটিটিউট এবং দক্ষিণ এশিয়া সলিডারিটি ইনিশিয়েটিভ তার চলচ্চিত্রের প্রথম উত্তর আমেরিকান ‘ফিরে দেখা’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন দেখার জন্য মানিকগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান তারেক মাসুদ এবং অধ্যাপক, সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। এই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিনসহ চারজন।
পরে তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন ক্যাথরিন মাসুদ।