মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জের ধরে আবারও কেঁপে উঠছে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফ। কখনও দিনে, কখনও রাতে সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। সেইসঙ্গে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের পশ্চিম-দক্ষিণ গ্রামগুলো থেকে দেখা মিলছে ধোঁয়ার কুণ্ডলিও।
সব মিলিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন টেকনাফের স্থানীয়রা।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকদিন বিরতির পর গত মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের ওপার থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে। শনিবার বিকাল ৪টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত থেমে থেমে শব্দ অব্যাহত ছিল।
এর আগে গত ১৫ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছয়টি ও রাত সাড়ে ১২টার দিকে থেমে থেমে কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। তবে ঈদের আগের দিন ও ঈদের দিন কোনও শব্দ শোনা যায়নি। ঈদের পর দিন থেকে আবার ভেসে আসতে থাকে বিস্ফোরণের শব্দ।
সবশেষ শুক্রবার মাঝরাতে মর্টার শেল ও শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দাদের। সকাল-দুপুর পেরিয়ে শনিবার বিকাল পর্যন্ত থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিল বিস্ফোরণের শব্দ। অসংখ্য শব্দের মধ্যে মর্টার শেল ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দও ছিল বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
ওপারের বিস্ফোরণে এপারের টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের নাইট্যংপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, পল্লানপাড়া, অলিয়াবাদ, কুলালপাড়া, খাংকার ডেইল, টেকনাফ সদরের ডেইলপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, সাবরাং পানছড়িপাড়া, সিকদারপাড়া, মগপাড়া, আচারবনিয়া, ঝিনাপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া, উত্তরপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়াসহ অন্তত ২৭ গ্রামের ঘরবাড়ি কাঁপছে।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ শরিফ জানান, শুক্রবার মাঝরাত থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০-৬০টি মর্টার শেলের শব্দ শুনেছেন। কয়েক মাস ধরেই এমন শব্দ শোনা যাচ্ছে। এসব ঘটনা মিয়ানমারের হলেও এপারের আতঙ্ক কমছে না।
সাবরাং এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক জেলা পরিষদের সদস্য শফিক মিয়া বলেন, “এলাকার মানুষ ভালোভাবে ঘুমাতেই পারছে না। দিনের বেলা তো যেমন-তেমন। রাতের বেলায় বিকট শব্দের আতঙ্কে থাকে এলাকার মানুষজন। জনগণের নিরাপত্তায় সেখানে বিজিবি টহল ও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।”
মাঝরাতে বিকট শব্দে ঘরের দরজা-জানালা কেঁপে ওঠে, ঘুম ভেঙে যায়। পরে ভয়ে আর ঘুম আসে না, জানালেন পৌরসভা বাসিন্দা এম কায়সার।
মৌলভীপাড়ার আবদুল করিম বলেন, “বিস্ফোরণের পাশাপাশি মংডু শহরের পশ্চিম ও দক্ষিণের গ্রাম থেকে আগুনের কুণ্ডলি দেখা যাচ্ছে। এপার থেকে আমরা ধারণা করছি গ্রামগুলো হয়ত জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
টেকনাফের নাফ নদীর পূর্ব পাশে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের কাদিরবিল, মংনিপাড়া ও সুদাপাড়া গ্রাম। নদীর এপার থেকে এসব এলাকার বাড়িঘর আগুনে পুড়তে দেখা গেছে।
টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, “মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণের শব্দ এবং রাখাইন রাজ্যে এলাকার ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।”
স্থানীয়রা বলছেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া অধিকাংশের বাড়ির মালিক রোহিঙ্গা নাগরিকরা। ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকেই নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অবশ্য অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন, টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ।
তিনি বলেন, “অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে কঠোর অবস্থানে বিজিবি। রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।”
বিকট শব্দে ঘুম ভাঙার কথা জানালেন টেকনাফের ইউএনও মো. আদনান চৌধুরী। তিনি বলেন, “সংঘাত-সংঘর্ষ মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু তারপরেও এপারের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারছে না।”
বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।