মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফে গত এক বছরে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১০১টি। তাদের মধ্যে ৪৬ জনকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে মুক্তিপণ দিয়ে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সী মানুষকে এনে জিন্মি করা হচ্ছে এই পাহাড়ে। কাউকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও অনেককে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে মিয়ানমারে।
কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এই উপজেলার দুর্গম পাহাড়-বন অপহরণকারীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। এই অপহরণ চক্রে সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষই রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ এর মার্চ নাগাদ টেকনাফে পাহাড়কেন্দ্রিক যে ১০১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ৫১ জন স্থানীয় এবং ৫০ জন রোহিঙ্গা।
সম্প্রতি এখানে ঘটেছে চারজনকে অপহরণের ঘটনা। এর মধ্যে দুজন কৃষক ও দুজন মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার্থী। ৫০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ নিয়ে দুই কৃষক ছাড়া পান। তবে এখনও হদিস মেলেনি মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীর। মাদ্রাসার আরেক শিশু শিক্ষার্থীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার পর জানতে পেরেছে, শিশুটিকে মিয়ানমারে পাচার করা হয়েছে।
গত ৯ মার্চ মধ্যরাতে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা গ্রামের আলী আহমদ (৬০) ও সৈয়দ আলম (৪০) নামের দুই কৃষক। আগের দিন সকালে বাহারছড়ার জাহাজপুরা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহৃত হন তারা।
৯ মার্চ দুপুরে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকা থেকে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাকে (৬) অটোরিকশায় তুলে অপহরণকারীরা নিয়ে যায় বলে জানান টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি।
আব্দুল্লার মা নুরজাহান বেগম বলেন, হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রাহমত উল্লাহ, সাদিয়া, আব্দুর রহিম, শাহ আলম ও নুর আলমসহ কয়েকজনের সঙ্গে তাদের পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এর জেরেই তার সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে বলে তার ধারণা।
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি চকরিয়া ফাঁসিয়াখালি দারুল উলুম মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাশিকুল ইসলাম নিখোঁজ হন বলে জানান র্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী।
রাশিকুলকে ফিরে পেতে মুক্তিপণ দেওয়া হয় দেড় লাখ টাকা। তারপরও তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এরপর র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন জানান, মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার আগেই এই শিক্ষার্থীকে পাচার করা হয় সংঘবদ্ধ চক্রের মিয়ানমার সিন্ডিকেটের কাছে। বর্তমানে সে মিয়ানমারেই জিন্মি রয়েছে।
টেকনাফের পাহাড় ও মিয়ানমারের চামিলা গ্রাম
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের পাহাড় থেকে গত বছরের ১৬ মার্চ ৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। দুজনকে ছেড়ে দিয়ে সাতজনকে জিম্মি করে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
ওই বছরের ১৮ মার্চ এই সাতজন ফিরে এসে পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণকারী চক্রের আস্তানার খবর দিয়েছিলেন।
তারা বলেছিলেন, সেখানে ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ের গুহায় আস্তানা তৈরি করা হয়েছে। সেখানেই নির্যাতন চালিয়ে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
টেকনাফের পাহাড় ছাড়াও মিয়ানমারের চামিলা গ্রামে জিন্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
মিয়ানমারের চামিলা গ্রামটি আনাপারাং থানায়। মিয়ানমার ভাষায় এর ভিন্ন নাম রয়েছে। গ্রামটির একটি অংশ মংডুর, অন্যটি বুচিডং জেলা শহরের আওতাধীন।
বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা অনেকে জানিয়েছেন, প্রথমে তাদের জিন্মি করা হয় টেকনাফের লেঙ্গুরবিলে। তারপর ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারের চামিলা গ্রামে।
বাংলাদেশ সর্বদক্ষিণের প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের উপকূলবর্তী একটি গ্রাম ‘চামিলা’। এই গ্রামে রয়েছে দেড় শতাধিক মগ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ঘর। গ্রামে বসবাসকারী সবাই সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্য, এমনটাই বলছেন ফিরে আসা ব্যক্তিরা। তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে ধরে সেখানে নিয়ে মুক্তিপণে জন্য চালানো হয় নির্যাতন।
অপহরণের ৩ কারণ
অপহরণের ঘটনার ধরন, অপহৃত ব্যক্তি এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মিলিয়ে টেকনাফে অপহরণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়।
এক. মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা মাদকের লেনদেন। দুই. সাগরপথে মানবপাচারকারী চক্রের প্রলোভন। আর তিন. সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের এলাকায় রয়েছে ৩০টির বেশি ইয়াবা কারখানা। শুধু বাংলাদেশে পাচারের জন্য এসব কারখানায় ইয়াবা তৈরি করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন, ইয়াবা কারবারে জড়িত ব্যক্তি এবং অপহৃতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসা এসব ইয়াবা মূলত বাকিতেই পাঠানো হয়। শর্ত দেওয়া হয় ইয়াবা বিক্রি করে টাকা পরিশোধের। কখনও কখনও বন্ধক রাখা হয় মানুষ।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ইয়াবা লেনদেনের জের ধরে কিছু ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। যা অপহরণ, মুক্তিপণ হিসেবে ধরা হলেও পরে তদন্ত করে দেখা গেছে মাদক সংশ্লিষ্ট। টেকনাফ বা উখিয়ায় টাকার বদলে একজনকে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে আসে। ইয়াবা দেওয়ার সময় বলা হয়, বিক্রি করে টাকা সঠিক সময় না দেওয়া হলে জিম্মি রাখা মানুষকে হত্যা করা হবে। এটা ব্যবসার নতুন কৌশল।
কক্সবাজারের সাগর পথে অবৈধভাবে মানবপাচার নতুন কিছু না। সেই মানবপাচার চক্রের প্রলোভনের শিকার বা প্রতারণামূলক জিম্মি করে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটছে।
কক্সবাজার আদালত ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ৬৫০টির বেশি মানব পাচারের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি এক হাজারের বেশি। ২০১২ সালের পর থেকে হওয়া এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি।
কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, “সংকট ও নানা কারণে এখন পর্যন্ত একটি মামলার বিচারও শেষ করতে পারিনি আমরা। তবে আদালত মানব পাচার মামলাগুলো দ্রুত বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।”
মাদক লেনদেন বা মানবপাচার ছাড়াও অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে একই চক্রটি, যার শিকার হয় কৃষকসহ সাধারণ মানুষ। তারা নানা কৌশলে মানুষকে পাহাড়ের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটায়।
বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবুল মঞ্জুর বলেন, “পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আটক করা কঠিন কোনও কাজ না। রহস্যজনক কারণে এটা হচ্ছে না। অপহরণের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গেছে স্থানীয়রাও।”
তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।
জড়িত কারা
গত ১৭ মার্চ টেকনাফে অপহরণের শিকার ৭ জনের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গহীন পাহাড়ের কোলে রয়েছে অসংখ্য গুহা। এসব গুহাকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে সশস্ত্র অপরাধীরা। চালায় ব্যাপক নির্যাতন। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশিরাও।
গহীন পাহাড় হলেও ওখানে অপরাধী চক্রের প্রধানসহ কয়েকজন ব্যবহার করে ল্যাপটপসহ আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইস। যার মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য জানতে পারে চক্রটি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, পাহাড়ে রান্না করলে আগুনের ধোঁয়া দেখে তাদের শনাক্ত করা যাবে বলে এসব অপহরণকারীদের খাবার সরবরাহ করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ। টানা চার/পাঁচ দিন পাহাড়ে থাকলে মোবাইল ফোনে চার্জ থাকার কথা না। তাই তারা ব্যবহার করে পাওয়ার ব্যাংক। এমনকি পাহাড়ের আশেপাশে কে আসছে কে যাচ্ছে, এমন খবরও স্থানীয়রা অপহরণকারীদের মোবাইলে জানিয়ে দিচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, “স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া কোনও অপরাধ করা সম্ভব না।”
গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে, এ অপহরণের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র চারটি দল সক্রিয় রয়েছে। এদের সঙ্গে কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততাও রয়েছে।
একসময় টেকনাফ থানায় দায়িত্ব পালনকারী ওসি মো. আবদুল হালিম (পরে তিনি বদলী হন) জানান, একটি অপহরণের ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় পুলিশের অবস্থান পাহাড়ের ভেতরে থাকা অপরাধীরা জেনে যাচ্ছে। কারণ বের করতে গিয়ে দেখা যায় পাহাড়ের আশে-পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরা খুলে নেওয়ার পর বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি তাকে ধমকের সুরে কথা বলেছিলেন।
এই পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, মূলত মিয়ানমারে টাকা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার, মুক্তিপণের টাকা গ্রহণের পুরোটাই এসব জনপ্রতিনিধিরা নিয়ন্ত্রণ করেন।
অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় বন্ধে স্থানীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন মাদক ও মানবপাচার রোধ করাও। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে।