মিয়ানমারে সংঘাত কবে বন্ধ হবে? সেই প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে অলস বসে আছেন ট্রাকচালক আমির হোসেন। তার মতোই প্রশ্ন টেকনাফ স্থল বন্দরের ১ হাজারের মতো শ্রমিকের। নাফ নদীতে মাছ ধরা ট্রলারগুলোর মাঝি-মাল্লারাও এখন অলস বসে খুঁজছেন একই প্রশ্নের উত্তর।
নিজের জীবিকার প্রয়োজনেই বাংলাদেশি এই শ্রমিকরা মিয়ানমারের সংঘাতের অবসান চাইছেন। কেননা, ওপারের সংঘাতে টেকনাফ স্থল বন্দরে পণ্য আসা কমে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন এপারের শ্রমিকরা।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ কয়েক মাস হলো তীব্র রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইনেও সংঘাত চলছে। তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে গোলা এসে বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুও ঘটিয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে শনিবার দুপুর থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি বলে জানান সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সালাম।
শনিবার বিকালে গুলিবিদ্ধ নারীসহ যে পাঁচজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন, তাদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজিবি সদস্যরা তাদের নৌকায় আটকে রেখেছিলেন। পরে কী করা হয়েছে, তা আর বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেছেন, স্থল ও নৌ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল বাড়ানো হয়েছে।
এই সংঘাতের পরোক্ষ প্রভাব সীমান্ত বাণিজ্যে যে স্থবিরতা নামিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের রেখা এখনও ফোটেনি।
টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর ও আকিয়াব বন্দর থেকে প্রতিমাসে আড়াই থেকে তিন শতাধিক কার্গো ট্রলারে করে বিভিন্ন ধরনের (দৈনিক ৮০ থেকে ১৫০ ট্রাক) পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া হয়।
তবে গত এক মাস ধরে দিনে মাত্র ২ থেকে ৩টি কাগো ট্রলার আসছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সৈয়দ আনসার মোহাম্মদ কাউসার বলেন, “আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবিরই বলা চলে। এখানকার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন।”
স্থল বন্দরের শ্রমিকদের নেতা আলী আজগর বলেন, তারা প্রায় এক হাজার শ্রমিকের প্রায় সবাই এখন বেকার।
স্বাভাবিক সময়ে স্থল বন্দরে দিনে ৬০ থেকে ৯০টির মতো ট্রাক থেকে পণ্য ওঠা-নামা হতো।
“কিন্তু ওপারে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এখন এক সপ্তাহেও একদিনের কাজ হচ্ছে না। কোনও কোনও দিন একটি ট্রাকও স্থল বন্দর ছেড়ে যায়নি।”
ট্রাকচালক আমির হোসেন বলেন, “আগে মাসে তিন-চারটি ভাড়া নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম যেতাম। এবার গত ১৭ দিনে একটি ভাড়াও পাইনি। শুধু আমি না, আরও প্রায় দেড়-দুই শতাধিক ট্রাক রয়েছে।”
টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানিকারক মোহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে।
আকিয়াব বন্দরে কিনে রাখা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শত শত মণ আদা, নারকেল, শুঁটকি, সুপারি ও ছোলা মজুদ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো না আনতে না পারলে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হবে।”
মিয়ানমারের হিয়ায়িত মাছ আমদানিকারক এম কায়সার জুয়েল বলেন, মংডু থেকে অনেক পণ্য আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আকিয়াব বন্দর থেকে হঠাৎ করে পণ্যভতি কার্গো ট্রলার ও জাহাজ আসছে। গত শুক্রবার দুটি ট্রলারে করে দেড় হাজার বস্তা আদা, নারিকেল, আচার, সুপারি, শুঁটকি আমদানি হয়েছে।
বন্দরে পণ্য কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়েও টান পড়েছে। আগে যেখানে মাসে ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো, তা গত কয়েক মাসে ৩০-৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে বলে জানান
টেকনাফ স্থল বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা এ এস এম মোশাররফ হোসেন।
গত এক মাস ধরে দিনে ২ থেকে ৩টি কার্গো ট্রলার এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব।
বন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুর রহমান বলেন, সব মিলিয়ে সীমান্ত বাণিজ্য নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।
সীমান্তে সংঘাত নাফ নদী ব্যবহার করে গভীর সাগরে যাওয়া টেকনাফের ৬ শতাধিক ট্রলারের মালিক ও জেলেদের জীবনযাত্রাও জটিল করে তুলেছে।
এই নাফ নদীর দুই পাশে দেই দেশ। নদীর এক পাশে কক্সবাজার, তার ঠিক ওপারেই মংডু।
টেকনাফের কায়ুখালী, সাবরাং কয়েকটি ঘাট, শাহপরীরদ্বীপ ঘাট থেকে বিভিন্ন ট্রলার এই নদী হয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়।
ট্রলার মালিক মোহাম্মদ হোসেন জানান, গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি ট্রলারও সাগরে যেতে পারেনি। ওপারে গোলাগুলির কারণে তাদের মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ।
নাফ নদী হয়ে গভীর সাগরে যায় ৬ শতাধিক ট্রলারের ১১ হাজারের বেশি জেলে। তারা এখন বেকার।
সাবরাং নয়াপড়া এলাকার ট্রলার মালিক আবদুল গফুর বলেন, “আগে জানলে ট্রলার নাফ নদীতে না এনে পশ্চিমের সাগর মোহনায় রাখতাম। কিন্তু এখন সাগরেও যাওয়া যাচ্ছে না।”
টেকনাফের পূর্ব পাশে নাফ নদী, পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর। এখন পূর্ব পাশে ভেড়ে থাকা ট্রলারগুলো পশ্চিম পাশে নিতে গেলেও নাফ নদী ধরে সাগরে গিয়ে তারপর যেতে হবে।
বিপাকে রয়েছেন চিংড়ি চাষিরাও। টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্তে নাফ নদীর এপারে রমজান আলীর রয়েছে ৬০ একর চিংড়ি ঘের। ১০ ফেব্রুয়ারি গোলাগুলির পর থেকে আতঙ্কে আছেন তিনি।
রমজান বলেন, “নাফ নদীর এপারে ৬০ একর চিংড়ি ঘের বর্গা নিয়ে চাষ করছি। বছরে বর্গা দিতে হয় ৯ লাখ টাকা। আমার ২০ জন কর্মচারী। তারাও আতঙ্কিত, আমরাও আতঙ্কিত। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে চরম লোকসান গুনতে হবে।”
একই এলাকার চিংড়ি চাষি শাহীন শাহজাহান বলেন, “এবছর ৫ লাখ টাকার বাগদা চিংড়ি মাছের পোনা দিয়েছি। মাছও বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু এখন ঘেরে যেতে পারছি না। লোকসানের ঝুঁকি বাড়ছে। কিছু করার নেই।”
টেকনাফের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, হোয়াইক্যং ও হ্নীলা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের আশপাশে ২ হাজার ৪০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে ৪০০ চিংড়ি ঘের রয়েছে। যেখানে ৮ শতাধিক চাষি। মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।