বিশ্বের অন্য স্থানের ধারাবাহিকতায় তাপমাত্রা বাড়ছে বাংলাদেশেও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত মার্চে প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৬৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও চড়বে, এমন পূর্বাভাসও দিচ্ছে একাধিক জলবায়ু সংস্থা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মার্চের ধারাবাহিকতায় এপ্রিলেও তাপমাত্রার পারদ নামবে না। মাঝে মধ্যেই তাপমাত্রা অধিক হারে বাড়বে। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় বাড়বে মানুষের অস্বস্তি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে একে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তা তীব্র তাপপ্রবাহ । আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে গণ্য হয়।
এই মাসের শুরুর দিকেই অধিদপ্তর জানায়, ঢাকাসহ দেশের তিন বিভাগের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ বিস্তার লাভ করতে পারে। তাপমাত্রা ৮ ও ৯ এপ্রিল কিছুটা কমার সম্ভাবনা আছে। সঙ্গে হতে পারে সামান্য বৃষ্টি।
তবে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ জানান, এখন যে তাপ তাতে সাধারণ একটু আধটু বৃষ্টিতে গরম কমবে না, দরকার মুষলধারে বৃষ্টি। কিন্তু এর সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
‘চ্যাঞ্জেস ইন হিউম্যান হিট ডিসকম্ফোর্ট অ্যান্ড ইটস ডাইর্ভাস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স ডিরেক্ট’ বলছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে উল্লেখযোগ্যহারে মানুষের অস্বস্তি বাড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এই তাপমাত্রা বেশি বাড়ছে যা দিনকে দিন আরও বাড়বে।
চুয়াডাঙ্গায় টানা ছয়দিন ধরে মাঝারি তাপপ্রবাহের পর গত শনিবার থেকে শুরু হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। ওইদিন বেলা ৩টায় সেখানে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, যা ছিল চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর এই তাপমাত্রা ছিল ঢাকার চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।
দেশের ১৭টি এলাকা নিয়ে করা এক জরিপের ফল থেকে সায়েন্স ডিরেক্ট জানায়, ১৯৬১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গত ৫৯ বছরে দেশের তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর আর্দ্রতা বেড়েছে শূন্য দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে। গত কয়েক দশকে এটা বেশি বেড়েছে ঘণবসতিপূর্ণ ঢাকা ও সিলেটে।
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে, এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে গোটা জাতির উপর। বিশেষ করে মানুষের কর্মক্ষমতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এর মধ্যে অন্যতম।
গত কিছু দিনের তীব্র এই দাবদাহে পুড়ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কয়েক দশক ধরেই এ নিয়ে কথা বললেও পরিবেশবিদদের হুঁশিয়ারি আমলে নেওয়া হয়নি। ফিলিপাইনে তীব্র দাবদাহের কারণে কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তীব্র দাবদাহের কারণে মাথা ঘোরা ও ব্যথার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শিক্ষকরা জানান, এমন তাপমাত্রার মধ্যে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়াসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তীব্র গরমে হিটস্ট্রোক হয়। ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয় মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ সময়টা খুবই শঙ্কার। চর্মরোগ, খিঁচুনি, ক্লান্তিবোধ, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত বের হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
ইতোমধ্যে গত ৩ এপ্রিলে মাদারীপুরের কালকিনিতে তীব্র গরমে হিটস্ট্রোক করে শুক্কুর আলী নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, হিটস্ট্রোক সবার হতে পারে। তবে শ্রমজীবী মানুষ যেমন- পোশাক কারখানার শ্রমিক, কৃষক, রিকশাচলকসহ যারা খোলা ও বদ্ধ জায়গায় কাজ করেন, তাদের এ শঙ্কা বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মাদ শাইখ আবদুল্লাহ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতি বছরেই তীব্র গরমে অসুস্থ হওয়া অনেক রোগী পাই। কিন্তু এ বছর এখনও সেভাবে রোগী পাইনি।”
সাধারণত মে ও জুনে তীব্র গরমের সময়ে রোগী আসতে থাকে। এসময় হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া,পানিবাহিত রোগ, জন্ডিস, টাইফয়েড, পেটের সমস্যাতে অনেকেই আক্রান্ত হয়। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
এবিষয়ে ডা. মোহাম্মাদ শাইখ আবদুল্লাহর পরামর্শ হলো – বাইরের বা রাস্তার ধারের পানি অথবা শরবত না খেয়ে বাসা থেকে আনা পানির বোতল সঙ্গে রাখা। দীর্ঘসময় হাঁটার দরকার হলে ছায়াযুক্ত স্থান দিয়ে হেঁটে চলা ও সঙ্গে ছাতা রাখা।
চিকিৎসকরা বলছেন, যারা হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত, এই তীব্র গরমে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মানুষের শরীরও গরম হয়, তখন রক্তনালী খুলে যায়। আর এ কারণে রক্ত চাপ কমে যায়। তখন শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হৃদপিণ্ডের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
পরিবেশ, জলবায়ু নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে পুরো ‘ইকো সিস্টেম ড্যামেজ’ হয়। তাপমাত্রা বাড়লে ‘সোয়েটিং’ হয়। তখন ব্রেইনের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় আর এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে।”
মিশিগান স্টেট ইউনির্ভাসিটির এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গবেষণায় বলছে, অপটিমাল (কাম্য অবস্থা) তাপমাত্রার ওপরে প্রতি ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়লে ২ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। অর্থাৎ একজন মানুষ যদি সপ্তাহে গড়ে পাঁচদিন কাজ করতে পারতেন তাহলে বছরে কমপক্ষে তিনি পাঁচদিন কম কাজ করতে পারবেন বা পাঁচদিনের আয় হারাবেন।”
আর সায়েন্স ডিরেক্টর লস অব ওয়ার্ক প্রোডাক্টিভিটি ইন এ ওয়ার্মিং ওয়ার্ল্ড শীর্ষক আরেক গবেষণা বলছে, তাপমাত্রা বাড়ায় শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত হয়। এতে কাজের পরিবেশ ও তাদের উৎপাদনশীলতা কমে।
জাকির হোসেনের মতে, জলবায়ুর এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পানির উৎস কমে হবে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে। এটি বর্তমানে ১০০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪৩ শতাংশ। এসব কিছু মিলিয়েই মানুষের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। শেষ পর্যন্ত এটা প্রভাব ফেলবে কর্মক্ষমতায়, যা একটি দেশের পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, তীব্র দাবদাহ শুধু মানুষের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি কৃষিক্ষেত্রেও বিরাট বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে ধান চাষে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভিয়েতনামে খালের পানির স্তর এত কমেছে যে অনেক এলাকার কৃষকরা তাদের ফসল পরিবহনে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ব্যাংকক পোস্ট বলছে, থাইল্যান্ডে ফসলের উৎপাদন কমায় এ বছর কৃষকদের ঋণ আট শতাংশ বাড়বে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাপমাত্রা বাড়ায় মানুষ তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এর সবগুলোই শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।
“মানুষ অসুস্থ হয়, মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ও ক্লান্ত থাকে। সে কাজে অনুপস্থিত থাকে। কাজে এলেও তার কার্যক্ষমতা পুরোটা কাজে লাগাতে পারেন না। আর শেষ পর্যন্ত অনেকেই হিটস্ট্রোকসহ অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এতে তার পুরো পরিবার অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “তাপমাত্রার বৃদ্ধি বা যে কোনও জলবায়ু পরিবর্তন কতটা প্রভাব ফেলে জীবনে, তা বুঝতে হলে উপকূলীয় অঞ্চলে যেতে হবে। ঘরে ঘরে দেখা যাবে সেখানকার মানুষের শারীরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা।”
জাকির হোসেন খান ও ডা. লেলিন চৌধুরী-দুজনেরই মতে, প্রকৃতি উত্তপ্ত হচ্ছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে বিরূপ আচরণ। দখল হচ্ছে নদী, ভরাট হচ্ছে পুকুর, খাল-বিল। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এর খেসারত মানুষকে দিতে হচ্ছে।