মিয়ানমার থেকে ছোড়া আরও একটি মর্টারের গোলা বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়েছে। অবিস্ফোরিত মর্টারের গোলা পড়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বিস্ফোরিত গোলা এসে পড়েছে বান্দবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নে।
বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘুমধুমের পশ্চিম পাড়ায় বিকট শব্দে আছড়ে পড়ে একটি গোলা। এতে কেউ হতাহত না হলেও পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গতরাতেই ঘোনার পাড়া এলাকায় উড়ে আসে অবিস্ফোরিত একটি গোলা। পরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা তা হেফাজতে নেন।
গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে টানা গোলাগুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন বান্দরবান ও টেকনাফ সীমান্তের লাখো মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না তারা, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে ২০টির বেশি মর্টারের গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশের মাটিতে।
বান্দরবান সীমান্তে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত
জেলার ৪৬৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি। যার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে ঘুমধুম মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী। এই ইউনিয়নের ১৫ কিলোমিটারের অবস্থান মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষে। যেখানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের।
বুধবার দুপুরে তবব্রু সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গোটা এলাকা নীরব। ঘর থেকে খুব প্রয়োজন না হলে বের হচ্ছেন না স্থানীয়রা। সংঘাত মিয়ানমারের ভেতরে হলেও দু’পক্ষের ছোড়া গুলি ও মর্টারের গোলা মাঝে মধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশিদের বাড়ি ও ফসলের জমিতে এসে পড়ছে। সীমান্তের খুব কাছাকাছি আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার। ভয়ে সীমান্ত লাগোয়া জমিতে চাষাবাদের কাজেও যাচ্ছেন না স্থানীয় কৃষক।
কেবল ঘুমধুমেই যে এই চিত্র তা নয়, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, দোছড়ি ও বাইশারী ইউনিয়নেরও অন্তত ২২ হাজার মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে।
স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান এই সংঘর্ষ তাদের যাপিত জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। নিত্যদিনের কাজে বের হতে ভয় পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অবিভাবকরা।
সোমবার দুপুরে কোনার পাড়া এলাকায় পাওয়া যায় বিস্ফোরিত মর্টারের গোলার কিছু অংশ। পরের রাতে আসে অবিস্ফোরিত গোলা আর সবশেষ দুপুরে এল বিস্ফোরিত গোলা। এসব ঘটনায় কোনও হতাহত না হলেও বিষয়টি তাদের জন্য আতঙ্কের। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ।
ঘুমধুম পশ্চিম পাড়ার আবু সিদ্দিক জানান, দুপরে বিকট শব্দে গোলাটি এসে পড়লে স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করেন।
ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নুরজাহান বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই অবস্থা চলছে। সীমান্তের ওপারে গোলাগুলিতে কেঁপে ওঠেন তারা। কখন গোলাগুলি শুরু হয় তা বোঝা মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেও ভয় পান অভিভাবকরা।
তমব্রুর কোনার পাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক জানালেন, মধ্যরাতে গোলাগুলি শুরু হলে মাটির বা কাঁচা বাড়ির বাসিন্দারা আশপাশের পাকা দালানে গিয়ে আশ্রয় নেন। মঙ্গলবার রাতে গোলাগুলি মুরু হলে অনেকে দালানে আম্রয় না পেয়ে সীমান্ত সড়কের ওপরেও আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। সীমান্তের ৩৩-৩২ নম্বর পিলার এলাকার কৃষকদের চাষাবাদ এখন পুরোপুরি বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। জনমানবহীন হয়ে পড়েছে বাজারগুলো। বেচাবিক্রি তেমন না থাকায় অনেকেই বন্ধ রেখেছেন দোকানপাট। কখন উড়ে এসে পড়ে গোলা, সেই আতঙ্ক সবার মধ্যে।
তমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হামিদুল ইসলাম বলেন, গোলাবর্ষণের খবরে বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা আসছেন না। ফলে পণ্য সংকটও বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
টেকনাফ সীমান্তেও আতঙ্ক
কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়ার ও জাদিমোরার লাল দিয়া সীমান্তে বিপরীতে মিয়ানমার অংশ থেকেও তেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির শব্দ। মঙ্গলবার কোনও গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া না গেলেও বুধবার দিন শুরু হয়েছে আতঙ্ক দিয়ে।
হ্নীলা ইউপির নয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, রাত তিনটা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত উপজেলার দমদমিয়ার ও জাদিমোরার লাল দিয়ায় সীমান্তে বিপরীতে মিয়ানমারের জামবনিয়া, রাইম্মবিল, পেরাংপুরু ও কাইনবন্যা এলাকা থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে।
ফলে সীমান্তের এ পারের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সতর্ক প্রশাসন
বান্দরবান ও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
বুধবার দুপুরে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন।
এসময় তারা এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে কথা বলেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে।
পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, “সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে। পুলিশি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে এবং জোরদার করা হয়েছে।”
স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। জানান, জনগণকে নিরাপদ রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি তাদের রয়েছে।
পরিস্থিতির অবনতি হলে সীমান্তে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন। তিনি স্থানীয়দের আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন।
ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, পরিস্থিতি খারাপ হলে অবস্থা বুঝে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী জানান, সীমান্তে বসবাসকারীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারিও রয়েছে।
সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কোনও সুযোগ নেই।
জোরদার কোস্টগার্ডের টহল
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে টেকনাফ সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবির পাশাপাশি টহল এবং নজরদারি জোরদার করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।
কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লে. কমান্ডার লুৎফুল লাহিল মাজিদ জানান, দেশটিতে নতুন অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে মানব পাচার, চোরাচালান, মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশসহ নতুনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।
টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া ও সেন্টমার্টিনে অতিরিক্ত কোস্টগার্ড সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।