ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্পিনিং, উইভিং এবং ডাইং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানায় চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। মালিকপক্ষ বলছে, গত দেড় বছরে এই সঙ্কট এতোটাই তীব্র হয়েছে যে কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমতে কমতে নেমে এসেছে ৪০-৫০ শতাংশে।
এই পরিস্থিতিতে আসন্ন কোরবানির ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে পেট্রোবাংলাকে চিঠিও দিয়েছে মালিকপক্ষ বিটিএমএ।
তবে শ্রমিকপক্ষ মালিকদের এই যুক্তির সঙ্গে একমত নন। তারা বলছে, কোনও সমস্যা হলেই মালিকপক্ষ শ্রমিকদের পাওনা নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। গ্যাস সঙ্কটের বিষয় সরকারের সঙ্গে মালিকপক্ষের বোঝাপোড়ার বিষয়। এখানে শ্রমিকদের কোনও কিছু করার নেই। তাহলে কেন এর জন্য ক্ষতির মুখে পড়বেন শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন- পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঈদের আগে তারা কোনও শ্রমিক অসন্তোষ চান না। অসন্তোষ এড়াতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়ার তা নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়ে টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ) গত ৪ জুন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয়। চিঠিতে সংগঠনটি জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
‘উৎপাদন নেমে এসেছে ৪০-৫০ শতাংশে’
স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলের অধিকাংশই ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। মিলগুলোর বয়লারেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস লাগে।
বিটিএমএর তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, মাওনাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত বিটিএমএর সদস্য মিলগুলোয় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রাপ্ত গ্যাসের গড় পিএসআই ‘০’-২ এর মধ্যে। যেখানে বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ দরকার।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এর ফলে মিলগুলো চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। মিলের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কম্পিউটারাইজড মেশিনারিজ নষ্ট হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার গড়ে ৪০-৫০% ব্যবহার করতে পেরেছে।
পেট্রোবাংলাকে দেওয়া চিঠিতে বিটিএমএ বলেছে, সরকার গত বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক মিটার ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে ৩১.৫০ টাকা ধার্য অর্থাৎ ৯৬.৮৭ শতাংশ বাড়ায়। এসময় মালিকদের আশ্বস্ত করে বলা হয়, এরপর থেকে শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
“কিন্তু দুঃখজনক বিষয় এই যে বিগত এক বছরের বেশি সময় যাবত বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফ মিলগুলো প্রদান করলেও গ্যাসের সরবরাহ কখনোই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি”, বলা হয়েছে ওই চিঠিতে।
বিটিএমএর তথ্যমতে, টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ খাতের জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশ এ খাতে থেকে আসে। তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে প্রাইমারি টেক্সটাইল খাত প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে।
প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতের মিলগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠির বস্ত্রের মৌলিক চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণটাই যোগান দিচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। এ খাতে কর্মরত জনগোষ্ঠি ১০-১২ লাখ, যার প্রায় ৬০ শতাংশই নারী।
গত ৪ জুন পেট্রোবাংলাকে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ওই চিঠি দেন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে এটাই সংগঠনটির প্রথম চিঠি নয়। এর আগে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে এ ধরনের চিঠি দিয়েছে তারা। কিন্তু কেউই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করে আসছে বিটিএমএ।
চিঠিতে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ ও তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না কারখানাগুলো। ফলশ্রুতিতে সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন হ্রাস ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ ফেব্রিক প্রসেসিং ব্যয়ও বেড়েছে, যা এ খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এর সরাসরি প্রভাব রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে পড়েছে।
গ্যাসের অভাবে যদি বিটিএমএর মিলগুলো সময়মতো তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সুতা-কাপড় সরবরাহ করতে না পারে তাহলে যথাসময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করা সম্ভব হবে না বলেও চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে বিটিএমএ সভাপতি আরও বলেন, “গ্যাসের তীব্র সংকট থেকে পরিত্রাণ প্রদানের লক্ষ্যে মিলগুলোয় নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বারংবার সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুরোধ করেও গ্যাস সরবরাহে কোনও অগ্রগতি পাওয়া যায়নি। বরং গত কয়েকদিন ধরে মিলগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ নেই বললেই চলে।”
এ অবস্থা চলতে থাকলে মিলগুলো আর কতদিন চালু রাখা সম্ভব হবে তা নিয়েও চিঠিতে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, “আসন্ন ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে শ্রমিক-কর্মচারীদের বোনাস, বেতন ভাতা প্রদানে চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, যা আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে মর্মে আমরা আশংকা করছি।
“বেতন ভাতা ও ঈদ বোনাস যথাসময়ে প্রদান করতে না পারলে যদি কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয় তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো অবস্থায় শিল্প মালিকগণ থাকবেন না।”
‘সব দায় কি শ্রমিকের’
কারখানায় যে সমস্যাই হোক তার দায় কি শ্রমিকের- এই প্রশ্ন রেখেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, মালিকদের এই স্বভাব পুরাতন। কোনও একটা সমস্যা হবে, তারা বলে দিবে- বেতন-বোনাস দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি বলেন, “গ্যাস সংকট আছে। তা নিয়ে সরকারের সাথে বোঝাপোড়া করবে মালিকরা। এটা তাদের আদায়ের বিষয়। মালিকদের অনেকেই এমপি, না হলে মন্ত্রী। তারা (বিটিএমএ) তাদের (মন্ত্রী-এমপিদের) নিয়ে সরকারের কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা বুঝে নিক। এখানে শ্রমিকদের কী করার আছে?”
মন্টু ঘোষ বলেন, “শ্রমিকরা তো কাজ করার জন্য কারখানায় এসেছে। তারা তো কোনও দোষ করেনি। মালিকরা কি অন্য সাপ্লাইয়ারদের টাকা আটকে রেখেছে? তাহলে শ্রমিকদের টাকা কেন আটকাবে?
“ঈদের সময় শ্রমিকের বেতন-বোনাস নিয়ে কোনও টালবাহানা করা যাবে না। আমরা শ্রমিকদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-বোনাস যেন দেওয়া হয় সেইদিকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছি।”
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বেতন-বোনাস নিয়ে কোনও রকম শ্রমিক অসন্তোষ যেন না তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
মন্ত্রণালয়ের রপ্তানিমুখী শিল্প ও আইও অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বৃহস্পতিবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিটিএমএর চিঠি দেওয়ার বিষয়টা আমি জানি না। তবে আমরা আমাদের কাজ করছি। বেতন-বোনাস নিয়ে কোনও রকম অসন্তোষ তৈরি হোক আমরা চাই না। আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বলেছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে।”
তিনি বলেন, “এখনও ঈদের কয়েকদিন বাকি। আমরা নিশ্চয়ই এই অবস্থা পরিবর্তনের একটা উপায় বের করতে পারব। শিল্প রক্ষায় আমরা আশা করি, সবাই তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।”