ভ্রমণ, চিকিৎসাসহ পর্যটক টানতে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসা সুবিধা ২ জানুয়ারি থেকেই কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে থাইল্যান্ড।
এখন একজন বাংলাদেশি নিজেই অনলাইনে আবেদন করে থাইল্যান্ডের ই-ভিসা পেতে পারবে। বর্তমানে থাইল্যান্ডের স্টিকার ভিসা পেতে হলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আবেদন করতে হচ্ছে; যাতে অন্তত ৩০ দিন সময় লাগছে।
নতুন সুবিধায় আবেদনের ১০ দিনেই এই ভিসা মিলবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের দুতাবাস।
ভারতের পথ বন্ধ থাকায় ব্যাংককের পদক্ষেপে বাংলাদেশের বড় সংখ্যক পর্যটক থাইল্যান্ডে যাওয়ার কথা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কত সংখ্যক পর্যটক থাইল্যান্ডে যাবে, তা নির্ভর করবে কী পরিমাণ ভিসা ইস্যু করছে তার ওপর।
চিকিৎসা, ভ্রমণ, কেনাকাটার জন্য বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যায় পাশের দেশ ভারতে। ২০২৩ সালে ১৪ লাখের মতো বাংলাদেশি ভারতে গেছেন, যা একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ। ভিসা পাওয়া সহজ এবং ব্যয় কম হওয়ায় বাংলাদেশিদের বড় গন্তব্য ছিল ভারত।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটক ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত। শুধু চিকিৎসা ভিসা এবং শিক্ষার্থীদের ভিসা দিলেও তা সীমিত। ফলে নতুন গন্তব্য খুঁজতে হচ্ছে বাংলাদেশি পর্যটকদের। বিকল্প হিসাবে সামনে থাকছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো।
এর মধ্যেই নভেম্বরে বাংলাদেশিদের জন্য থাইল্যান্ড নতুন ভিসা সুবিধা চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। ডিসেম্বরে এসে সেই দিনক্ষণ এবং প্রক্রিয়াও ঘোষণা হলো।
কীভাবে অনলাইনে আবেদন
সোমবারের ঘোষণায় থাই কর্তৃপক্ষ বলেছে, ২ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদন নেওয়া হবে। আবেদনকারীদের https://www.thaievisa.go.th এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আবেদন করতে হবে। আর ভিসা ফি পরিশোধ করতে হবে অনলাইনে দুতাবাসের নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
আবেদনের ১০ দিনের মধ্যে ইমেইলে এ ভিসা দেওয়া হবে। এরপর সেটি প্রিন্ট করে বিমানবন্দর পার হওয়ার সময় ইমিগ্রেশনে পাসপোর্টের সঙ্গে উপস্থাপন করতে হবে।
এতদিন ঢাকা, চট্টগ্রামে অবস্থিত ভিসা সেন্টারের মাধ্যমে স্টিকার ভিসা ইস্যু করত থাই দুতাবাস। এতে সময় লাগত অন্তত ৩০ দিন। জমা দিতে হতো আবেদনকারীর পাসপোর্ট।
ই-ভিসা চালুর পর ঢাকার থাইল্যান্ডের ভিসা সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দূতাবাস।
কতটা সুফল মিলবে
বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিমানের পাশাপাশি বাস ও ট্রেনেও যাওয়া যায়। ফলে খরচ হয় কম। কিন্তু থাইল্যান্ডে যাওয়ার ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের বিকল্প নেই। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসার পাশাপাশি ফ্লাইটও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
ই-ভিসা বাংলাদেশিদের জন্য বড় সুবিধা হিসাবেই দেখছেন বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের অনারারি কনসাল আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এতে একজন আবেদনকারীর পাসপোর্ট জমা দেওয়া ছাড়াই নিজ থেকে আবেদনের সুযোগ থাকায় ভোগান্তি কমবে। আর থাই ভিসার আবেদন হচ্ছে সবচেয়ে সহজ, এক পৃষ্ঠার। এখন দিনে গড়ে ৬০০ থেকে ৮০০ ভিসার আবেদন জমা পড়ছে; বিপরীতে সমপরিমাণ ভিসা ইস্যু হচ্ছে।
“ই-ভিসা চালু হলে কত দিনে মোট কত ভিসা ইস্যু হবে, সেটি এখনও জানার সুযোগ নেই। সবেমাত্র এই পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তারা আবেদন যাচাই করতে প্রাথমিকভাবে ১০ দিন সময় নিয়েছে। ২ জানুয়ারি থেকে কত আবেদন পড়ছে, সেটির ওপর নির্ভর করছে আবেদন নিষ্পত্তির সময় কমবে কি না?”
বর্তমানে থাইল্যান্ডের ভিসার আবেদন জমা নেয় সেদেশের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ‘ভিএফএস’ এবং ‘সাইমন’। নতুন প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ না থাকায় তা দ্রুত হওয়ার কথা।
তবে তাতে একটি সমস্যার কথাও বলেন চট্টগ্রামভিত্তিক ট্রেফেল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইমাদে রব্বানী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভিসা প্রসেসিং থার্ড পার্টির মাধ্যমে করার একটা সুবিধা আছে। থার্ড পার্টির কর্মকর্তারা আবেদন নিয়ে সব ডকুমেন্ট যাচাই করেন, তারপর ভিসার জন্য অ্যাম্বাসিতে আবেদন জমা নেন। কোনও ডকুমেন্ট ঘাটতি থাকলে সেটি জমার আগেই পুরণ করে দেওয়ার সুযোগ থাকে। কারণ আবেদনকারী কতটা নিখুঁতভাবে ফরমে তথ্য ইনপুট দিচ্ছেন, সেটার ওপর ভিসা পাওয়া নির্ভর করছে। আবার ভুল তথ্য দিলে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হবে।”
বর্তমানে ভিসা সেন্টারের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের ভিসার আবেদন করতে একজন আবেদনকারীকে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ হাজার টাকা জমা দিতে হচ্ছে। ই-ভিসায় ফি কত, তা এখনও ঘোষণা দেয়নি থাই কর্তৃৃপক্ষ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ফি ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা হতে পারে। তা জানা যাবে ২ জানুয়ারি।
বাংলাদেশে থাই দুতাবাস বলছে, বিদেশি পর্যটকদের টানতে এরই মধ্যে থাইল্যান্ড বিশ্বজুড়ে ৬৯টি দূতাবাসে ই-ভিসা চালু করেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে তার সর্বশেষ সংযোজন।
থাই ভিসা পেতে নতুন যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশি পার্সপোর্টধারীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় থাই দূতাবাসের মাধ্যমে ডিটি (ডেসটিনেশন থাইল্যান্ড) ভিসার আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ডিটি ভিসা পাঁচ বছরের জন্য দেওয়া হয়। এই ভিসায় একজন ব্যক্তি থাইল্যান্ডে একবার সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকতে পারেন। এই ভিসায় রোগীর সঙ্গে একজন সেবাদানকারী (কেয়ারগিভার) ব্যক্তি আসতে পারবেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ভিসার জন্য ব্যাংককে বাংলাদেশি দূতাবাসের সুপারিশপত্র লাগবে না।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা বিনা ভিসায় দুদেশে ভ্রমণ করতে পারছেন। এখন কূটনৈতিক পাসপোর্টের পাশাপাশি সরকারি পাসপোর্টধারীরা আগামী ১৯ ডিসেম্বর থেকে সেই সুবিধা পাবে।
ভিসা সহজ করায় ২০২৫ সালে বড় সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশ ভ্রমণের জন্য থাইল্যান্ডকে বেছে নেবে বলে আশা করছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো।
ফ্লাইট কি বাড়বে
বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা ছাড়া অন্য কোনও বিমানবন্দর থেকে থাইল্যান্ডে যাওয়ার ফ্লাইট নেই। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাইল্যান্ডের সূবর্ণভূমি আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এখন দিনে সরাসরি ফ্লাইট আছে চারটি বিমান সংস্থার। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস, থাই এয়ারওয়েজ, ব্যাংকক এয়ার।
থাইল্যান্ড পৌঁছতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা: ফলে সেদিক বাংলাদেশিদের জন্য থাইল্যান্ড আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। কারণ কাছাকাছি দূরত্বে আর কোনও দেশ নেই। আর বিমান ভাড়াও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের চেয়ে কম।
ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডে দিনে সরাসরি দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাই এয়ারওয়েজ। বিমান সংস্থাটির বাংলাদেশের সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এয়ার গ্যালাক্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ই-ভিসা চালু হলে এবং ভিসা যদি ভালো পরিমাণ ইস্যু হয়, তাহলে ভারতগামী অনেক পর্যটকের বড় গন্তব্য হতে পারে থাইল্যান্ড।
বাংলাদেশিরা সেদিকে ঝুঁকবেন বলে আমার ধারণা। আর ভিসা বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা বাড়তি ফ্লাইট পরিচালনা করব।”
থাইল্যান্ড-চট্টগ্রাম ফ্লাইট চালু কবে
থাইল্যান্ড থেকে চট্টগ্রামের আকাশপথের দুরত্ব দুই ঘণ্টা। অর্থাৎ ঢাকার চেয়ে আধা ঘণ্টা কম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে কেউ দেশটিতে যেতে চাইলে তাকে আগে ঢাকায় যেতে হয়। কারণ চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংককের কোনও ফ্লাইট নেই।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে তিনি বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
“তিনি বিবেচনার করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। অন্য দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সকেও আমি অনুরোধ জানিয়েছি। তা বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম থেকে পূর্বমুখী যেকোনো গন্তব্যে ব্যাংকক হয়ে যাত্রার সুযোগ হবে।”
চট্টগ্রাম এভিয়েশন ক্লাবের সভাপতি আসিফ চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আগে চট্টগ্রাম থেকে রিজেন্ট এয়ারে করে সরাসরি থাইল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ ছিল। সর্বশেষ থাই স্মাইল চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট চালিয়েছিল।
“আমরা থাই এয়ারওয়েজ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি থাইল্যান্ড এবং সেখান থেকে পূর্বমুখী গন্তব্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু দেশের এখনকার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সেই সিদ্ধান্ত আমরা পিছিয়েছি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমরা চালু করব।”
কত পর্যটক যায় থাইল্যান্ডে?
থাইল্যান্ড পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ পর্যটক পেয়েছে তারা। পর্যটকের তালিকায় শীর্ষে ছিল মালয়েশিয়া। শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কত পর্যটক থাইল্যান্ডে গেছে, সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৯ সালের হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার যাত্রী থাইল্যান্ডে গেছে। এরমধ্যে চিকিৎসার জন্য গেছে ৪৩০০ জন। অধিকাংশেই গেছে কেনাকাটা কিংবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।
থাইল্যান্ড ২০২৪ সালে ৩ কোটি ৬০ লাখ পর্যটক টানার লক্ষ্য ঠিক করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৬০ লাখ পর্যটক পেয়েছে। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলেই তারা আশাবাদী।
২০২৫ সালে থাইল্যান্ডের লক্ষ্য ৪০ লাখ পর্যটক। ২০১৯ সালে দেশটিতে ৩৯ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে গিয়েছিল।